জটিল জিনগত রোগ অ্যালবিনিজমে আক্রান্ত চীনা কিশোরী হুয়েই অ্যাবিং। মেয়ের অস্বাভাবিক রোগ দেখে ত্যাগ করেছিলেন বাবা-মা। ফেলে গিয়েছিলেন অনাথ আশ্রমে। কিন্তু এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও আজ খ্যাতির শিখরে ১৬ বছরের এই কিশোরী।
মডেল হিসেবে ইতিমধ্যেই বেশ নাম করেছেন হুয়েই। ফ্যাশন দুনিয়ার প্রথম সারির পত্রিকা ভোগের হয়ে মডেলিং করেছেন। ডিজাইনার মহলেও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে তার। কাজ করেছেন দুনিয়ার সেরা ডিজাইনার এবং ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে।
অ্যালবিনিজম রোগে শরীর নিজের স্বাভাবিক রং হারায়। ত্বকের জরুরি উপাদান মেলানিনের অভাবে স্বাভাবিকত্ব হারায় ত্বক, চুল, চোখ। দৃষ্টিশক্তিতেও এর প্রভাব পড়ে।
এই রোগে আক্রান্ত হুয়েইয়ের দৃষ্টিশক্তিও মাত্র ১০ শতাংশ। বেশি আলো সহ্য করতে পারেন না তিনি। তবু সেজেগুজে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোয় তার জুড়ি নেই।
শ্যুটিংয়ের জন্য বেশি আলো জরুরি। চোখ বাঁচাতে তাই হুয়েই বেশির ভাগ ছবিই তোলেন চোখ বন্ধ করে। হুয়েইয়ের কথায়, চোখ না বুজলে ক্যামেরার আলোয় এমনিই চোখ চেপে বন্ধ করে ফেলি। তখন ছবি বাজে ওঠে।
ডিজাইনারদের অনেকেরই মত, হুয়েইয়ের ত্বক-চুলের বিশেষত্বই তাকে মডেল হিসেবে চ্যালেঞ্জিং বানিয়েছে।
অথচ জন্মের পর হুয়েইকে অস্বীকার করেছিলেন তার বাবা-মা। জীবনের প্রথম তিনটি বছর অনাথ আশ্রমে কেটেছে হুয়েইয়ের।
নিজের জন্মদিন জানেন না হুয়েই। এক বছর আগে পর্যন্ত নিজের বয়স সম্পর্কেও কোনো ধারণা ছিল না তার। হাতের এক্সরে করাতে গিয়ে চিকিৎসকরা তার বয়স সম্পর্কে একটি ধারণা পান। গত বছর হুয়েই জানতে পারেন তার বয়স ১৫ বছরের আশেপাশে।
এক সাক্ষাৎকারে হুয়েই বলেছিলেন,আমার জন্মের সময়ে চীনে এক সন্তান নীতি চলছিল। এক বার সন্তান হলে আর দ্বিতীয় সন্তানের জন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যেত না। এই পরিস্থিতিতে এই রোগ নিয়ে জন্মেছিলাম আমি। বাবা-মা আমাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি ই বা মনে করতেন?
জন্মের পরই হুয়েইকে অনাথ আশ্রমে ছেড়ে এসেছিলেন তার বাবা-মা। হুয়েই নামকরণ করেন সেই অনাথ আশ্রমে এক কর্মী। চীনে ‘হু’ শব্দের অর্থ বরফ। আর ‘ই’ মানে সুন্দর। হুয়েই মনে করেন, এর থেকে ভাল নাম তার আর হতেই পারত না।
তিন বছর বয়সে তাকে দত্তক নেন নেদারল্যান্ডসের এক নারী। নতুন মা এবং বোনের সঙ্গে চীন থেকে নেদারল্যান্ডসে চলে আসেন হুয়েই।
ঘটনাচক্রেই ১১ বছর বয়সে মডেলিংয়ে আসেন হুয়েই। হংকংয়ের এক ডিজাইনারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল তার মায়ের। সেই ডিজাইনার ‘পারফেক্ট ইমপারফেকশন’ নামে একটি ফ্যাশন শোয়ের আয়োজন করেন। তথাকথিত কিছু শারীরিক অস্বাভাবিকত্ব সত্ত্বেও কী ভাবে ফ্যাশনকে ভালবাসা যায়,তা নিয়েই ফ্যাশন শো।
হুয়েই জানিয়েছেন, ওই ডিজাইনারের ছেলের ঠোঁটের সমস্যা ছিল। তিনি এমন পোশাক বানাতে চেয়েছিলেন, যাতে পোশাক ছেড়ে ঠোঁটের দিকে নজর না যায়। হুয়েইকে ওই বিশেষ ফ্যাশন শোয়ে যোগ দিতে বলেন তিনি। হুয়েই জানিয়েছেন, বছর চারেক আগের সেই অভিজ্ঞতার কথা জীবনে ভুলবেন না তিনি।
ফ্যাশন শোয়ে নজরে পড়েন হুয়েই। পর পর ডাক পেতে শুরু করেন ফ্যাশন ফটোশ্যুটের জন্য। বেশ কিছু মডেলিং এজেন্সিও যোগাযোগ করতে শুরু করে তার সঙ্গে। তার করা একটি ফটোশ্যুটের ছবি প্রকাশিত হয় ফ্যাশন পত্রিকা ভোগে।
হুয়েই জানিয়েছেন, ‘ভোগ’ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তার। কেন তাতে ছবি বেরনোর জন্য সবাই এত উৎসুক, তা তখনও জানতেনই না তিনি। তবে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেন।
হুয়েই জানিয়েছেন, ফ্যাশন দুনিয়ায় দেখতে আলাদা হওয়া যে আসলে আশীর্বাদ তা এখন বুঝেছেন তিনি।
বিরল জিন রোগ অ্যালবিনিজমে আক্রান্ত হন প্রতি ১৭ হাজারে একজন। হুয়েই জানিয়েছেন, এই রোগে আক্রান্তদের রীতিমতো ঠাট্টা করা হয়। অনেক সময় ভূত, ভিন্গ্রহী জাতীয় মন্তব্যও করা হয়। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও যে শীর্ষে যাওয়া যায় নিজের মডেলিংয়ের মধ্যে দিয়ে তার সেই বার্তা পৌঁছে দিতে চান তিনি।
মডেলিংয়ের কাজের মধ্য দিয়েই লাখ লাখ অ্যালবিনোকে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন বলে মনে করেন এই কিশোরী।