করোনার প্রকোপে বিশ্ব আজ লন্ডভন্ড। এর থাবা পড়েছে শিক্ষাঙ্গনেও। প্রায় এক বছর হয়ে গেল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণচাঞ্চলে যখন মুখরিত হওয়ার কথা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন; ঠিক তখন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আজ বন্দি মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ও কম্পিউটারের খাঁচায়। অনেকেই বলছেন, অনলাইন ক্লাসে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। উন্নতি কিছুটা হচ্ছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু আমরা তাদের দীর্ঘস্থায়ী কি যে ক্ষতি করছি তা অত্যন্ত ভয়াবহ। আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার, ধর্ম-নৈতিকতা ও সমাজব্যবস্থার সাথে অনলাইন ক্লাস কতটুকু মানানসই ও কার্যকরী তা খতিয়ে দেখার দরকার বলে বিজ্ঞসমাজ মনে করেন।
অনলাইন ক্লাসের সুবিধা কিছুটা আছে। ঘরবন্দি সময়ে পড়াশোনাটা অন্তত চালু রাখা যায়। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এর ক্ষতিকর দিকটা কতটা মারাত্মক। অনলাইনের ক্লাসের ক্ষতিকর দিকগুলোকে মোটা দাগে আমরা তিনটা ভাগে ফেলতে পারি। শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত ও নৈতিকতাগত। শিক্ষাগত সমস্যার মধ্যে প্রধান হলো, স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা ও নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যাবহারিক ও গভীর জ্ঞানের ঘাটতি। কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও কিছু মজার বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী মোবাইলের স্পিলিট স্ক্রিন সুবিধার মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসেও থাকছে, আবার একই স্ক্রিনে নিচে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করছে, মানে আড্ডায় মেতে উঠছে। অনেকে শুধুমাত্র ক্লাসে লগইন করে অন্যান্য কাজে লিপ্ত থাকছে। শিক্ষক তো খুশীতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন যে, ক্লাসে ৯০-১০০ ভাগ ছাত্র উপস্থিত। কিন্তু তারা নিজেরাও জানেন না ছাত্র-ছাত্রীরা অপরপ্রান্তে কি করছে। শিক্ষক বুঝতেই পারছেন না তাঁর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মন নেই। ব্যাপারটা সবাইকে চরম ভাবিয়ে তুলছে। অনেকেই বাড়ির কাজ ও পরীক্ষার উত্তর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে তৈরি করছে। সম্পূর্ণ প্রশ্ন না পড়ে এবং বিষয়টি না বুঝে একেক বন্ধু একেকটার উত্তর তৈরি করে পরিশেষে একত্রিত করে জমা দিচ্ছে। এতে তারা সবাই ১০০ তে ১০০ নম্বর পাচ্ছে। কিন্তু শিখছে না তেমন কিছু।
আর স্বাস্থ্যগত দিক? যে বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মানসিক বিকাশ হয় সেই সময়ে ঘরে বসে থাকায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে পড়ুয়ারা। চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই সাবধান করে দিয়েছেন যে, স্মার্টফোন ও কম্পিউটার ডিভাইসের রশ্মি চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। সেই সঙ্গে মানসিক ক্লান্তি আনে। শিশুকালেই তাদের চোখ ও কানের সমস্যা প্রকট হচ্ছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, মোবাইলের প্রতি ছোট বেলা থেকেই প্রবল আসক্তির কারণে অগণিত বাচ্চা আজ চোখের দৃষ্টি হারাচ্ছে অথবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হচ্ছে। এমনকি স্মৃতিশক্তিও লোপ পাচ্ছে। তাদের মধ্যে একঘেয়েমি ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। মেজাজ খিটখিটে ও চড়া হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য দীর্ঘ সময় হেডফোন ব্যবহারের ফলে ছোটদের কানে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অনেক ছাত্র বলছে যে, হেডফোনে ক্লাস করার পর তাদের কান ব্যথা করে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, টানা কয়েক ঘণ্টা ক্লাস করার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একঘেয়ে মনোভাবের সৃষ্টি হচ্ছে। নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকায় শিক্ষার্থীদের চোখে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার কারও কারও মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনের মত ব্যাধিও দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় একটানা চেয়ারে বসে ক্লাস করায় অনেক শিক্ষার্থীর পিঠ ব্যাথা করছে। এতে তাদের ঘাড় ও মেরুদন্ডে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ।
শিক্ষাগত ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের কারণে শিক্ষার্থীদের নৈতিক পদস্খলন হচ্ছে। যে শিশুদের নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মেতে থাকার কথা, তাদের হাতে এখন আমরাই তুলে দিয়েছি মোবাইল, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মতো ডিভাইস। পড়া তৈরি করা, হোমওয়ার্ক জমা দেওয়া, গ্রুপ-স্টাডি এসবের অজুহাতে সারাক্ষণই যেন অন্তর্জালে ফাঁদে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ছোট ছোট শিশুদেরও পরিচয় হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো ধ্বংসাত্মক অ্যাপসের সাথে। ধীরে ধীরে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে ভার্চুয়াল জগতে। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করছেন যে, ক্লাসের ছুতোয় দীর্ঘ সময় ধরে অহেতুক অনলাইনে থাকার কারণে যুবসমাজ ও কোমলমতি শিশুরা আজ গোল্লায় যাচ্ছে। যেহেতু ক্লাসের কথা বলে তারা অনলাইনের নানা কর্মকান্ডে ব্যাস্ত থাকছে, সেহেতু অভিভাবকবৃন্দও তাদেরকে কিছু বলতে পারছেন না। একজন অভিভাবক তো আপসোস করে বললেন, “অনলাইন ক্লাস এসে সব শেষ করে দিল। ক্লাসের নামে অনেক রাত পর্যন্ত আমার ছেলেটা মোবাইলে ব্যাস্ত থাকে। কিছু বলতে গেলেই বলে, ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছি”। বাকি যা বললেন তা অবর্ণনীয়।
ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে সকল অ্যাপস ব্যাবহার করে থাকে তার মধ্যে জুম, গুগল মিট, গুগল ক্লাস রুম, ওয়েবএক্স, ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউব অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সমস্ত অ্যাপস কতটুকু নিরাপদ। এটা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কি কি প্রভাব ফেলছে? জুম অ্যাপস কিছুটা নিরাপদ হলেও ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউব ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত মারাত্মাক। নিজের অজান্তেই তারা এমন এমন সাইটের ভিতর ঢুকে পড়ছে যা বর্ণনার যোগ্য নয়। তাই বিজ্ঞ অভিভাবকমহল আজ এ মন্তব্য করছেন, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে আমরা জেনেশুনে সর্বনাশ করছি না তো কোমলমতি এই শিশুদের?
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/এমএইচবি