খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

অধ্যাপকের নবজন্ম

কামরুল ইসলাম

অবসর গ্রহণের পরও অধ্যাপক সাহেব দুরন্ত যুবকের মত চলাফেরা করতেন। সারাদিন জনসেবা, ছেলে মেয়েদের সাথে উপদেশমূলক আলোচনা, ধর্ম কর্ম, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া, বাজার করা, গৃহপালিত পশু পাখির যত্ন নেওয়া, এমনকি ক্ষেত খামারে কাজ পর্যন্ত নিজের হাতেই করতেন। মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে দ্রুত নাস্তা খেয়ে কলেজে রওয়ানা দিতেন। বাড়ীর আঙ্গিনা পেরিয়ে খোলা মাঠ পায়ে হেটে পার হয়ে ভ্যানে চড়তে গিয়ে মনে পড়তো, তিনি তো অবসর নিয়েছেন। তখন কলেজে না গিয়ে অন্য দশজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের মত বাড়ী ফিরে যেতেন না। নানাবিধ সমাজ কর্মে সারাদিন সময় দিয়ে দুপুরের খাবার কোনদিন বাড়িতে যেয়ে খেতেন, আবার কোনদিন বাইরে কোথাও খেয়ে নিতেন। আসরের নামাজ বাড়ীর পাশের মসজিদে গিয়ে পড়তে তিনি বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তাই বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীর হাতের রান্না খাবার চেয়ে আসরের নামাজটা মসজিদে আদায় করার জন্যই বাড়ী ফিরে যেতেন। আসরের নামাজ শেষে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, কিছু ধর্মীয় আলোচনা করতে করতে কোন কোন দিন মাগরিবের ওয়াক্ত এসে পড়লে মাগরিবের নামাজ মসজিদে আদায় করে আবার মসজিদ থেকেই বেরিয়ে লেগে যান সমাজ কর্মে।

সারা জীবন এভাবে কাজ করে তিনি কিছুটা যন্ত্রের মত হয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ জ্বর-জারি, অসুখ-বিসুখ তার ধারে কাছে কোনদিন আসতে পারেনি। সারাটা জীবন তিনি তাঁর সমস্ত মেধা, কর্মশক্তি, যোগ্যতা সবকিছু অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে। লোভ-লালসা কি জিনিস তা কেউ কোনদিন তাঁর মধ্যে দেখেনি। শিক্ষার প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠার উজ্জ্বল নিদর্শণ বলতে যা বুঝায় তা ষোল আনাই অধ্যাপক সাহেবের মধ্যে চোখে পড়ার মত পরিমানে ছিল। অর্থের প্রতি কোন আকর্ষণ তাঁর মধ্যে কোনদিনই ছিল না। কোনমতে খেয়ে পরে সারা জীবন চলেছেন। অবসর গ্রহণের পর যে টাকাগুলো পেনশন পেয়েছিলেন তা দিয়ে হজ্জ্বব্রত পালন করার পর এখন দিন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। ঘটনাচক্রে এবং জীবনের বাস্তবতায় অধ্যাপক সাহেব এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম পক্ষের সন্তানেরা যার যার মত মোটামুটি স্বচ্ছল। দ্বিতীয় পক্ষের কোন সন্তানাদি না থাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে কখনও কোন বিপত্তি দেখা যায়নি। অবশ্য দুই পক্ষের এ ধরণের সহ অবস্থানের জন্য অধ্যাপক সাহেবের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশী। তাঁর শিশু সুলভ আচরণ ও ত্যাগের মানসিকতা দুই স্ত্রীর মধ্যে লাঠালাঠির পরিবর্তে সহ অবস্থানের পথকে প্রসারিত করে রেখেছিল। নারী সমাজে এরূপ দৃশ্য অত্যন্ত বিরল।

বয়স সত্তরের কোঠা পার হবার পর অধ্যাপক সাহেব এই প্রথম অসুখে পড়লেন। বেশ কিছুদিন বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছা থাকলেও টাকা খরচের ভয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে আল্লার উপর ভরসা করে পড়ে রইলেন। তা ছাড়া আর উপায় কি! পেনশনের সমস্ত টাকাই হজ্জ্বব্রত পালনে ব্যয় করার পর তিন বেলা ঠিকমত পেট পুরে খাবার যোগাড় করাই যেখানে কষ্টের সেখানে বড় ডাক্তার দেখিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাবেন কেমন করে ?

প্রথম পক্ষের স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়ীতে। সেখানে যা পৈত্রিক জমিজমা আছে তা দিয়ে তার সংসার কোনমতে চলে। দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন অধ্যাপক সাহেবের সারা জীবনের কর্মস্থলের পাশে। সেখানে সামান্য একটু জায়গা কিনে পাখির বাসার মত একটা ঘর করেছিলেন প্রায় বিশ বছর আগে। একটা দুধের গাভী ও কিছু হাঁস মুরগী পালন করে তার সংসার চলে। এখন অসুখের সময় সংসার থেকে অতিরিক্ত কিছু টাকা সংগ্রহ করে বুড়ো অধ্যাপকের চিকিৎসা করানোর কোন আগ্রহ কোন পক্ষেরই তেমন দেখা গেলনা। অধ্যাপক সাহেবও কারো কাছে হাত পাততে রাজী নন। তার চেয়ে আয়ু শেষ হয়েছে মনে করে চির বিদায় নেওয়াই উত্তম বলে ধরে নিলেন।

এলাকায় তার গুণগ্রাহীর অভাব ছিল না। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অগণিত ছাত্র ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মত মানুষ করেছেন। তাদের মধ্য অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। কোটি টাকার মালিকও বেশ কয়েকজন আছে। এমনকি বড় বড় ডাক্তার ছাত্রেরও অভাব নেই। তারা অনেকেই অধ্যাপক সাহেবের অসুখের কথা শুনেছে। কিন্তু কেউ কোন সাড়া দেয়নি। সকলেই বলে- অধ্যাপক সাহেব খুব ভাল মানুষ; তার তুলনা হয়না। তবু মরতে তো হবেই। বয়স তো কম হয়নি। এমনি আরো অনেক সুন্দর সুন্দর সহানুভূতিপূর্ণ উক্তি প্রায় সকলেই করতে শুরু করলো। আশপাশের দু’চার জন অতি সাধারণ লোকজন ও ছাত্র-ছাত্রী কিছু কিছু ফলমূল কিনে নিয়ে তাঁকে দেখতে যেত এবং সান্ত্বনার বাণী শুনাতো। অধ্যাপক তাতেই খুব খুশী হতেন। এই বাজারে এখনও মানুষের মধ্যে স্বহৃদয়ভাব যে আছে, তা দেখে তিনি গভীর শান্তি অনুভব করতেন এবং প্রাণভরে সকলের জন্য দোয়া করতেন।

অধ্যাপক সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী আমেনা বেগম কিছুটা মনখোলা মানুষ। তিনি কোন কথা মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারেন না। অধ্যাপক সাহেব তার ছাত্র-ছাত্রীদের আদর করে যেসব কথা বলতেন, আমেনা বেগম তার সূত্র ধরে আরো চার পাঁচ গুন শুনিয়ে দিতেন। এতে অধ্যাপক সাহেবের অসুস্থ শরীরের কিছুটা উপশম হত। ছেলে-মেয়েরাও আমেনা বেগমের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা মন দিয়ে শুনতো। মাঝে মাঝে আমেনা বেগম ছাত্র ছাত্রীদের আনা ফলের রস অধ্যাপক সাহেবের মুখে দিতেন। তখন অধ্যাপক সাহেব পরম তৃপ্তি সহকারে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে ও পাশে বসা দর্শনার্থীদের দিকে চেয়ে বলতেন ‘আমি মারা গেলে তোমাদের এই পাগলী মাকে তোমরা দেখেশুনে রেখো। আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আমি কিছুই রেখে যেতে পারিনি। ওকে দেখবারও কেউ নেই। ’

আমেনা বেগম শত কষ্টেও হাসতে জানতেন। অধ্যাপক সাহেব যখন নিজের মৃত্যুর চেয়ে তাকে নিয়ে চিন্তিত তখন আমেনা বেগম ব্যস্ত থাকতেন দর্শনার্থীদের নিয়ে। কাকে কি খাওয়াবেন এবং কিভাবে খুশী করবেন সেই চিন্তায় তিনি অস্থির থাকতেন। অধ্যাপক সাহেবের মনটা এজন্য আরো বেশী আনন্দিত হত। আমেনা বেগম মনে মনে ভাবতেন এমন কেউ কি নেই যে ঢাকায় নিয়ে অধ্যাপক সাহেবকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে বাড়ী ফিরিয়ে দেবে। কিইবা এমন বয়স হয়েছে। তার শাশুড়ী বেঁচে ছিলেন ১১৪ বছর। শ্বশুরও ১০০ বছরের উপরে। তাহলে তার স্বামীরও ৩০/৪০ বছরের আয়ু এখনও পড়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে করেন হজ্জ্ব না করে টাকাগুলো রেখে দিলে ওই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করানো যেত। এসব কথা চিন্তা করা পাপ এবং স্বামী যদি তার মনের এ কথা জানতে পারেন তবে ভীষণ কষ্ট পাবেন তা তিনি জানতেন। তবু মন কতো কথাই বলে। মনের উপর কারো জোর খাটেনা।

অধ্যাপক সাহেবের অসুস্থতা যখন চরম পর্যায়ে তখন একদিন তার সারাজীবনের লালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যমন্ডলী একটি ফুলের তোড়া ও ফলমূল নিয়ে দেখতে এলেন। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ও অনেকেই কানা কানি করে বলতে লাগলেন- ‘আর হবেনা, এইতো মানুষের জীবন।’ পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে অনেকে ছিলেন অধ্যাপক সাহেবের সরাসরি ছাত্র। এমনকি শিক্ষকবৃন্দের মধ্যেও। তারা সকলেই এসেছেন এক প্রকার শেষ বারের মত একবার দেখতে।

পূর্বে যত মানুষ দেখতে আসতো তাদের সবার সাথে আমেনা বেগম তার চিরকালের অভ্যাসসুলভ হাসি হেসে কথা বলতেন। কিন্তু আজ তার স্বভাবসুলভ সকল অভ্যাসের কাছে হার মেনে গেলেন। সকলে ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন এবং তারা যত সময় ছিলেন তত সময় শুধু কেঁদেই গেলেন। কাউকে কিছু আপ্যায়ন করাতো দূরের কথা, বসতে পর্যন্ত বলার মত পরিস্থিতি কখনও হয়নি। বরং সকলে তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাও কেঁদে ফেললেন। অধ্যাপক সাহেব সকলের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বললেন। মাঝে মাঝে বিছানা থেকে উঠে তাদের জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শরীরের কাছে এবং সহকর্মীদের জোরাজুরীতে হার মেনে গেলেন। তাই শুয়ে শুয়ে সকলের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন এবং শেষ বিদায় নিলেন।

অবশেষে বিদায়ের পালা। সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্যে অপেক্ষা করেনা। এবার যেতে হবে। অধ্যাপক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলেও আমেনা বেগমেকে কিছু সান্ত্বনার বাণী শোনানো দরকার মনে করে তার কাছে গেলেন। আমেনা বেগম প্রথম থেকেই একইভাবে কেঁদেই চলেছিলেন। এবার সকলকে বিদায় দিতে উঠোনে এলেন। অশ্রু কিছুটা সংবরণ করে বর্তমান অধ্যক্ষ মহোদয়ের হাত ধরে আস্তে আস্তে বললেন- ‘আপনারা একবার ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখালে হয়তো কিছু হতে পারে। তার বাবা-মা একশো বছরের বেশী বেঁচে ছিলেন; তার কেবলমাত্র সত্তর পার হয়েছে। আমার কাছে টাকা থাকলে আমি নিজেই নিয়ে যেতাম। উনি তো জীবনে কিছুই সঞ্চয় করেননি।’ আমেনা বেগম লজ্জার মাথা খেয়ে আবেগের মধ্যে একদমে কথাগুলো আস্তে আস্তে বলে গেলেন। কারণ অধ্যাপক সাহেব শুনতে পেলে কষ্ট পাবেন এবং বলতে বাধা দিবেন এ কথা তিনি জানতেন।

আমেনা বেগমের আবেদন শেষ হতেই আগত শিক্ষকবৃন্দ ও পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে মুখ চাওয়া চায়ী শুরু হয়ে গেল। কেউ কোন উত্তর দেন না। আমেনা বেগম কথাটা বলার আগে মনে আবেগ ছিল। তাই লজ্জা নামক বস্তুটি উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু এখন নিজের কাছে অপরাধী মনে হতে লাগলো। তাই মাটির দিকে তাকিয়ে লজ্জা নিবারণ করার চেষ্টা করলেন। শিক্ষকবৃন্দও কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এমন প্রস্তাবের জন্য কোন প্রস্তুতি তাদের কারো ছিল না। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক সাহেবের প্রিয় সহকর্মী সামছুল হক সাহেব অধ্যক্ষ মহোদয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন-‘স্যার আপনি কিছু একটা বলুন।’

অধ্যক্ষ মহোদয় গভীর বিপাকে পড়লেন। মৃত্যু পথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সাহেবের জন্য তার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কোন কমতি কখনও ছিলনা। আজও তা একইভাবে আছে। তিনি কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দের দিকে তাকালেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পুরনো কিছু কথা। একদিন এই অসুস্থ অধ্যাপক সাহেব অবসর গ্রহণের পর কলেজে গিয়েছিলেন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কিছু শ্রেণী শিক্ষা বহিঃর্ভূত শিক্ষামূলক আলোচনা করতে। অধ্যক্ষ মহোদয় বিষয়টি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি মেলেনি। তাই অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে রাত ১২ টার পরে অধ্যাপক সাহেবের কাছে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি না পাবার কারণও অধ্যক্ষ মহোদয়ের অজানা নয়। এই কলেজের জন্মলগ্ন থেকে অধ্যাপক সাহেব চাকরী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার সকল শ্রম ও মেধা দিয়ে কাজ করেছেন। অনেক লোভনীয় প্রস্তাব তার কর্মজীবনে হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু নীতির সাথে কখনও আপোষ করেননি। তাঁর এই আপোষহীন মানসিকতার জন্য তিনি কখনও পরিচবালনা পর্ষদের কাছে প্রিয়পাত্র ছিলেন না।

মূহুর্তের মধ্যে এমনি আরো শত শত স্মৃতি অধ্যক্ষ মহোদয়ের স্মৃতিপটে ফুটে উঠলো। মনে মনে ভাবলেন- তার নিজের কাছে কোন সঞ্চয় থাকলে আমেনা বেগমের প্রস্তাবে এখনই আশ্বাস দিতেন। নিজের অস্বামার্থহেতু তা দিতে পারছেন না। অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দের আর্থিক অবস্থাও তার অজানা নয়। কলেজ তহবিল ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ আর্থিক দিক থেকে অনেক স্বচ্ছল। ইচ্ছা করলে যে কেউ এই মরণাপন্ন অধ্যাপকের জন্য শেষ চেষ্টা করতে পারেন। কলেজ তহবিল থেকে খরচ করার মত মন থাকলেও অধিকার তার ছিল না। সব কিছুই পরিচালনা পর্ষদের হাতের মুঠোয়। মুখ দিয়ে ‘রা’ উচ্চারণ করার অধিকার তার নেই। মনে মনে ভাবলেন- তারও একদিন অধ্যাপক সাহেবের মত অবস্থা হতে পারে। তখন যা হবার হবে, আপাততঃ চাকরীটা বাঁচাতে মুখ বন্ধ রাখাই উত্তম। কিন্তু সামছুল হক সাহেবের কথার একটা উত্তর তো দিতে হবে। তিনি অধ্যক্ষ। এই অসুস্থ অধ্যাপক সাহেবের পরিদর্শনকারী দলের মাথা। নিজের ব্যক্তিত্ববোধ ও পদমর্যাদা তাকে রীতিমত দংশন করতে থাকলো। একবার সামছুল হক সাহেব আর একবার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দের চোখের দিকে তাকাতে থাকলেন। আমেনা বেগমের মুখের দিকে তাকাবার মত ‘মুখ’ তার নেই।

সামছুল হক সাহেব অধ্যক্ষ মহোদয়ের অপ্রস্তুত ভাব দেখে নিজেই লজ্জিত হলেন। তাকে উদ্ধার করতে বললেন-‘কলেজে গিয়ে একটা মিটিং ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং ফলাফল ভাবীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানিয়ে দেব।’ অধ্যক্ষ মহোদয়ের শরীরের ঘাম কিছুটা কমে গেল এবং সামছুল হক সাহেবের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কোনমতে বিদায় নিলেন। আমেনা বেগম ঘরে গিয়ে অসুস্থ স্বামীর সেবায় মনোনিবেশ করলেন। সদ্য আলোচনার বিষয়টি জানাবার কোন প্রয়োজন মনে করলেন না বা সাহস করলেন না।

সকল শিক্ষকবৃন্দ কলেজে ফিরে বিবেকের কাছে দংশিত হতে থাকলেন। কেউ কেউ বললেন- কী হবে এই চাকরী করে। আমরা সকলে ময়না পাখির মত। যা শিখেছি, তাই শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উদগীরণ করে দিতে পারি। কিন্তু নিজের কোন মতামত বাস্তবায়ন করতে পারিনা। ঘুড়ির মত উড়তে পারি। তবে লাটাই ধরতে পারিনা। আমাদের আছে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বক্ বক্ করার অধিকার। এ চাকরী করাই উচিৎ না। এমনি আরো অনেক দুঃখের কথা অধ্যক্ষ মহোদয়ের রুমে বসে চলছিল। অধ্যক্ষ মহোদয় অবস্থা বেগতিক দেখে সকলের জ্ঞাতার্থে বললেন- ‘আপনারা শান্ত হোন, দেওয়ালেরও কান আছে। আসুন আমরা স্যারের জন্য কিছু একটা করি।’

আবারও সামছুল হক সাহেব প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। তিনি বললেন- ‘স্যারের অনেক ভক্ত ছাত্র-ছাত্রী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অবস্থানে আছেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে কিছু একটা হতে পারে’। অধ্যক্ষ মহোদয় তার প্রস্তাবে একমত হলেন। সামসুল হক সাহেব বললেন- ‘মতিন সাহেব একজন চার্টার্ড একাউনটেন্ট। স্যারের খুব প্রিয় ছাত্র এবং ভক্ত। ঢাকায় তার বাড়ী-গাড়ী আছে এবং অনেক টাকার মালিক। তাকে ফোন করে দেখা যেতে পারে।’ তার প্রস্তাবে সকলে রাজী হলেন। ইতোপূর্বে মতিন সাহেব তার প্রয়াত বাবার নামে কলেজে একটা হোস্টেল করে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে মতিন সাহেবকে ফোন করে সাথে সাথে তাকে পেয়ে অধ্যাপক সাহেবের কথা জানালেন। মতিন সাহেবও সবকিছু শুনে আজই একটা এ্যাম্বুলেন্সে করে তার শ্রদ্ধেয় স্যারকে ঢাকায় পাঠাতে অনুরোধ করলেন। সকলে বললেন- ‘যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। চলেন আমরা সকলে আবার ফিরে গিয়ে ভাবীকে সান্ত্বনা দিয়ে এখনই স্যারকে রওয়ানা করে দেই’।

যে কথা সেই কাজ। ডুমুরিয়া হাসপাতালে ফোন করতেই খোকা ডাক্তার এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলেন। খোকা ডাক্তারও অধ্যাপক সাহেবের একজন ভক্ত ছাত্র। তিনি এখন স্থানীয় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্ণধার। তাই শিক্ষকবৃন্দ অধ্যাপক সাহেবের বাড়ী পৌঁছার আগেই এ্যাম্বুলেন্স হাজির হয়ে গেল। আমেনা বেগম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লেন। মনে মনে বললেন- ‘আল্লার মার, দুুনিয়ার বার’। ইতোমধ্যে শিক্ষকবৃন্দও হাজির হলেন। অধ্যাপক সাহেব বললেন- ‘কি ব্যাপার আপনারা আবার কেন?’ আমেনা বেগম বললেন- ‘উনারা তোমাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাবেন। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও। এখনই যেতে হবে।’ সবকিছু শুনে অধ্যাপক সাহেব হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন এবং ঢাকায় যাবেননা বলে বেঁকে বসলেন। তাঁর মনের কথাটি আমেনা বেগম বুঝতে পারলেন কিন্তু উপস্থিত সকল শিক্ষকবৃন্দ সামান্য মনোক্ষুণœ হলেন। তারা অধ্যাপক সাহেবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরে কিছুটা অহংকার বোধ করছিলেন কিন্তু তা বুঝি ভেস্তে যেতে বসেছে। অধ্যাপক সাহেব কার সাহায্যে, কেমন করে, কোথায়, কিভাবে চিকিৎসা হতে যাচ্ছেন তা না ভেবেই- অন্যের সাহায্যে চিকিৎসা হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় মনে করেন। কিন্তু শিক্ষকবৃন্দ নাছোড় বান্দা। তারা এক প্রকার জোর করেই তাঁকে এ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিলেন। সামছুল হক সাহেব নিজেই এ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে সাথে গেলেন। আমেনা বেগমও সাথে যাবার জন্য ছটফট করছিলেন কিন্তু এতদিনে স্বামীর সেবা করতে গিয়ে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে সাথে নিলে তার সেবা করতে আবার ডাক্তারের প্রয়োজন হবে। তখন মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। ওদিকে মতিন সাহেব ঢাকা থেকে বার বার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কখন রওয়ানা হলো, অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে কিনা, সাথে কে আসছে, একজন ডাক্তার বা নার্স সাথে আনলে ভাল হয় ইত্যাদি অনেক কিছু।

রোগীসহ এ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় পৌঁছালো মাত্র ৪ ঘন্টায়। মাওয়া ফেরীঘাটে বিশেষ ফেরী রেডি ছিল মতিন সাহেবের তদারকীতে। তাই সবকিছুতেই কম সময় লেগেছে। সরকারী হাসপাতালে সু-চিকিৎসা হয়না বলে মতিন সাহেব বড় একটি বেসরকারী ক্লিনিকে সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সেখানে ভর্তি করার পরপরই ডাক্তার সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা সেরে অপারেশন করার সময় নির্ধারণ করলেন পরদিন বিকাল পাঁচটায়। অধ্যাপক সাহেব আবারও বেঁকে বসলেন। কাটাছেড়া করে মরার চেয়ে সরাসরি মরার পক্ষে তিনি অবস্থান নিলেন। ডাক্তার ও মতিন সাহেব মহা বিপদে পড়লেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
পরদিন বিকাল পাঁচটায় বাধ্য হয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময় অধ্যাপক সাহেব সকলের কাছে শেষ বিদায় নিলেন। আমেনা বেগম মোবাইল হাতে নিতেই মুর্ছা গেলেন। তাই শেষ কথা হবার আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক এলো। মতিন সাহেব ও সামছুল হক সাহেবকে কোন কথা না বলে চোখের চাহনিতে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে শিশুর মত অভিমানের ভঙ্গিতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়লেন। যদি এমন কিছু হয়ে যায় তবে সব দায়ভার যেন মতিন সাহেব ও সামছুল হক সাহেবের । কারণ অপারেশনে অধ্যাপক সাহেবের কোন সম্মতি ছিলনা। অবশ্য সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা নালিশ কিছুই তার নেই।

অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। মতিন সাহেব ও সামছুল হক সাহেব বাইরে অপেক্ষায় আছেন। এদিকে এলাকায় কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ও শত শত সুভাকাংখী ঘরে ঘরে, মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে বসে প্রহর গুনছেন। কেউ কেউ মসজিদে বসে ক্বোরআন তেলাওয়াত করে প্রিয় অধ্যাপক সাহেবের জন্য দোয়া করছেন। আমেনা বেগম মুর্ছা যাওয়া থেকে জ্ঞান ফেরার পরপরই জায়নামাজে বসেছেন। নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত করেননি। যমদূত যাতে ঢাকার পথ না চিনে এখানে আটক থাকে সেজন্য যত রকম চেষ্টা সবই চালানো হচ্ছে।

রাত দশটার সময় অপারেশন শেষ হলো। সরাসরি তাঁকে নিয়ে গেল সি. সি. ইউ. তে। জটিল রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণতঃ এরকম করা হয়। সাধারণ অপারেশন হলে রোগীকে নরমাল কেবিনে আনা হয়। মতিন সাহেব ও সামছুল হক সাহেব এসব জানেন। তাই গ্রামের শুভাকাংখীদের ও আমেনা বেগমকে তারা কোন আশার বাণী শোনাতে পারলেন না। সারা রাত ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে বসেই আল্লাহকে ডাকতে থাকলেন। মাঝে মাঝে নার্সদের সাথে কথা বললেন তবে তারা কেউ মুখ খুলতে রাজী নন।

সকাল দশটার সময় ডাক্তার এলেন। তিনি দেখার পর বাইরে এলে দু’জনেই ডাক্তারের সাথে কথা বললেন। ডাক্তার জানালেন বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছুই বলা যায়না। ইতোমধ্যে এলাকা থেকে অসংখ্য ফোন আসতে থাকে। কিন্তু কাউকে সন্তোষজনক কিছু জানাতে পারেন না মতিন সাহেব ও সামসুল হক সাহেব। ফোনে ফোনে যখন দু’জনেই ঝালাপালা হয়ে পড়েছেন তখন ফোন করলেন আমেনা বেগম। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর দু’জনেই ঘুমে ও ক্ষুধায় একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে আমেনা বেগমকেও কোন সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারছেন না। সবকিছু মিলে তারা দু’জনে আমেনা বেগমের প্রশ্নের যেসকল উত্তর দিলেন তাতে আমেনা বেগম ধরে নিলেন যে, যমদূতকে কোনমতে আটকে রাখা গেলনা। আজই তাদের দুই সতিনের বৈধব্য জীবন শুরু হলো। এতদিন দুইজন ছিলেন দুই জায়গায়। আজ দুইজনই আমেনা বেগমের বাড়ীতে আছেন। দুই সতিনে সারা জীবনে সতিনসুলভ সম্পর্ক তেমন ছিলনা তবে আজ তাদের প্রকৃতই দুই বোনের মত মনে হচ্ছে। অধ্যাপক সাহেবের কোন সম্পদ না থাকায় ভবিষ্যতে তা নিয়ে ঝগড়া বিবাদের কোন সম্ভাবনা নেই। মনে মনে যেটুকু বিভেদ ছিল তা শুধু ভালবাসার অংশীদারীত্ব নিয়ে। আজ তার অবসান হলো। সূতরাং দু’জনে বোনের মত থাকাই সকল দিক থেকেই শ্রেয়।

দু’জনে মিলে শেষবার ফোন করলেন ঠিক বারটা পয়ত্রিশ মিনিটে। তখন মতিন সাহেব ও সামছুল হক সাহেব দু’জনেই কিছুটা ঘুমের ঘোরে। তাই অসাবধানতা বশে বললেন- ‘খবর তেমন ভালনা, পনের মিনিট পরে চূড়ান্ত অবস্থা জানাতে পারবেন।’ এ কথা শোনার পর দুই সতিনে আবার দুই বোনের মত গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকলেন। সময় আর যায়না। দশ মিনিট যেতেই আবার ফোন করলেন। কিন্তু কেউ আর ফোন ধরেন না। একবার মতিন সাহেব আর একবার সামছুল হক সাহেবের ফোনে কল করেন। কিন্তু দু’জনের কেউ ফোন ধরেন না। প্রায় একশো বার ফোন করার পরও যখন কেউই ফোন ধরেন না তখন সদ্য বৈধব্যে উপনীত হওয়া দুই বোন (ইতোপূর্বে যারা দুই সতিন ছিলেন) গগনভেদী চিৎকারে কান্না শুরু করে দিলেন। আমেনা বেগম চিৎকার করতে করতে একবার কলেজের দিকে, একবার বাজারের দিকে, একবার ফারুকের দোকানে, একবার সোনামুখ ভবনে পাগলীনির মত দৌঁড়াতে থাকেন। মুহুর্তের মধ্যে খবরটি রাষ্ট্র হয়ে গেল। স্কুল-কলেজ সবকিছু বন্ধ ঘোষণা হলো, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা টাঙ্গানোর হুকুম হলো, মসজিদে মসজিদে মাইকে ক্বোরআন তেলাওয়াত শুরু হলো, চায়ের দোকানে চা বিক্রি বন্ধ হলো। সর্বত্র শোকের ছায়া এবং অধ্যাপক সাহেবের গুণের আলোচনা চলতে থাকলো। মোবাইল ফোনের যুগ তাই যোগাযোগও অতি দ্রুত সম্ভব। প্রায় সবার হাতে মোবাইল। কেউ কেউ বিষয়টি নিশ্চিত হতে বার বার মতিন সাহেব ও হক সাহেবের মোবাইলে কল করলো। কিন্তু তিন চার ঘন্টা চেষ্টা করেও কোন উত্তর পেলেন না। তাতে আর কারও সন্দেহের অবকাশ রইল না। কোথায় দাফন করা হবে এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলো।

কলেজ পরিচালনা পর্ষদের জরুরী বৈঠক ডাকা হলো। সম্মানিত সদস্যবৃন্দ এবার সকলেই হাজির হলেন। একে একে সকলে কান্নাজড়িত কন্ঠে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করলেন। অধ্যাপক সাহেবের চাকরী জীবনে আপোষহীন থাকায় যিনি সবচেয়ে বেশী অখুশী ছিলেন আজ তার মুখেই বিলাপের খই ফুটতে লাগলো। যেন মায়ের পেটের ভাই মরলেও এমনটি কষ্ট পেতেন না। অবশ্য তার অন্তর্নিহীত কথা শুধু তিনিই জানেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি প্রস্তাব করলেন যে, অধ্যাপক সাহেবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার মৃতদেহ কলেজ প্রঙ্গনেই সমাহিত করা হবে। এই প্রস্তাবে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। কেউ কেউ আনন্দে হাত তালি দিতে গেলেন। কিন্তু তাতে শোক সভার গাম্ভীর্য নষ্ট হয় এবং নিজের মনের ও মুখের মধ্যে যে তফাৎ আছে তাও ফাঁস হয়ে যাবে। উভয়দিক চিন্তা করে সকলে আনুষ্ঠানিক সভা ভঙ্গ করে আমেনা বেগমকে সান্ত্বনা দিতে রওয়ানা হলেন। রুমের বাইরে অপেক্ষারত সকল ছাত্র-ছাত্রী সভাসদবৃন্দকে দেখার পর আর একবার কান্নার রোল পড়ে গেল।

একজন ছাত্রী অধ্যক্ষ মহোদয়কে বলেই ফেললো- ‘স্যার, আপদ বিদায় হয়েছে। আপনারা বেঁচে গেলেন। ঐ মানুষটি আর কখনও আপনাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে কলেজে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান করতে আসবেন না। শুধু শুধু কলেজের জায়গা নষ্ট করে আপরনারা তার মরদেহটিকে এখানে রেখে বৃথা সম্মান দেখিয়ে বাহবা কুড়াতে কেন চাচ্ছেন? তার চেয়ে স্যারের পবিত্র দেহটি শোলগাতির নদীতে ভাসিয়ে দেন। সারা জীবন যিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন আজ মরেও তিনি মাছের উদোর পূর্তি করে মাছের কল্যাণে নিজের নশ্বর দেহখানি উৎস্বর্গ করতে পারলে বেশী খুশী হবেন। দয়া করে লোক দেখানো স্বস্তা হাততালি নেবার কোন দরকার নেই। আপনারা ঐ সোনামুখ মানুষটাকে তৃপ্তি সহকারে ঘুমাতে দিন।’

অধ্যক্ষ মহোদয় মূর্তির আকার ধারণ করে সব কথা শুনলেন। তার সুন্দর মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কোন উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে সোজা অফিসে ঢুকে একটা সাদা কাগজ নিয়ে কি যেন লিখলেন। তারপর অফিস সহকারী মোঃ তোরাব আলীকে ডেকে তার কাছ থেকে একটা খাম নিয়ে নিজে কাগজটি খামে ভরে ভালভাবে আঠা দিয়ে মুখ আটকে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের প্রধান সাহেবের হাতে দিয়ে আস্তে আস্তে একাই অধ্যাপক সাহেবের স্ত্রী আমেনা বেগমকে দেখতে গেলেন।

বাড়ীর রাস্তায় যেতে যেতে দেখলেন সারা জায়গায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সবার মুখে শুধু অধ্যাপক সাহেবের গুণ কীর্ত্তণ হচ্ছে। অনেকে তাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরছেন। তিনি সবাইকে সান্ত্বনা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত ফারুকের দোকানে গিয়ে বসে পড়লেন। ফারুক অধ্যাপক সাহেবের প্রিয় ছাত্র এবং দীর্ঘদিনের সেবামূলক কর্মকান্ডের একান্ত সহযোগী। ফারুকেরও তেমন টাকা পয়সা নেই তবে জনসেবার অভ্যাস চিরদিনের। এজন্য অধ্যাপক সাহেব ও ফারুকের মধ্যে দারুন মিল ছিল। প্রায় প্রতিদিন সকাল সন্ধায় অধ্যাপক সাহেব ফারুকের দোকানে বসে চা নাস্তা খেতেন। ফারুক ধার দেনা করে সংসার চালালেও অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি করতো না। প্রতিদিন এভাবে অতিথি আপ্যায়ণ করতে গিয়ে সে দেনার ভারে দেউলিয়া হতে বসেছে। কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি কখনও দেখা যায়নি। তার দোকানে যারা নিয়মিত অতিথি ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক সাহেব।

ফারুক নিজেও এম. কম. পাশ। দীর্ঘদিন একটি আধা সরকারী অফিসে চাকরী করেছে। কিন্তু ঐ অফিসটি প্রায় দশ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই অকাল অবসরে গিয়ে আজ সে প্রায় দেউলিয়া। তার বদ অভ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যনীয় ছিল- মানুষের সমালোচনা করা। সে যা মনে মনে ভাবে তা হিতাহিত চিন্তা না করে মুখের উপর বলে ফেলে। এজন্য সে অনেকের কাছে অপ্রিয়। তাতে তার কিছু যায় আসেনা। উচিৎ কথা বলার অভ্যাস ছাড়তে পারেনি।

অধ্যক্ষ মহোদয় বেশ কিছু সময় কান্নাকাটি করার পর এখন শান্ত হয়েছেন। ফারুক বললেন- ‘দাদা, এক কাপ চা অর্ডার দেই।’ আগেই বলেছি যে, আপ্যায়নে ফারুকের জুড়ি নেই। এত দুঃখের মাঝেও চা অর্ডার দিতে ভুল করলে না। অধ্যক্ষ মহোদয় বললেন- ‘না থাক। চলেন স্যারের বাসায় যেয়ে ভাবীকে সান্ত্বনা দিয়ে আসি।’

ইতোমধ্যে ফারুকের দোকানে বেশ লোকজন জড় হয়ে গেছে। সকলের মুখে একই কথা এবং নানান রকম শোকের প্রকাশ। অধ্যাপক মহোদয়ের এত গুণ ছিল তা অনেকেই জানতো না। একজন লোকও পাওয়া গেলনা কান্না ছাড়া। সবার মুখে প্রশংসার ফুলঝুরি ফুটতে থাকলো। কেউ কেউ তাঁর কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আক্ষেপ করতে থাকলো। কবে কখন নিজের অজান্তে ভুল করে অধ্যাপক সাহেবের মনে কষ্ট দিয়েছিল সেজন্য বার বার নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলো। এতদ্বঞ্চলে কোন মানুষের মৃত্যু সংবাদে ইতোপূর্বে কখনও এরূপ প্রতিক্রিয়া কেউ কখনও দেখেনি। স্বার্থক হলো অধ্যাপক সাহেবের মৃত্যু। বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর পরই গুণ বিচার হয় আর জীবদ্দশায় হয় শুধু সমালোচনা এবং পদে পদে বাঁধা।

ফারুকের দোকান থেকে অধ্যক্ষ মহোদয় ও অন্যান্য সকলে মিলে প্রায় শত খানেক লোক রওয়ানা হলেন অধ্যাপক সাহেবের স্ত্রীদের সান্ত্বনা দিতে। সবাই একপ্রকার নীরবে হেটে চলেছেন। বাজারের এপার ফারুকের দোকান এবং বাজার পার হয়ে সামান্য দূরে মসজিদের পাশেই অধ্যাপক সাহেবের বাড়ী। সকলে মসজিদ পর্যন্ত যেতেই মসজিদের ইমাম সাহেব কাঁদতে কাঁদতে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসলেন। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে লক্ষ্য করে বললেন-‘‘অধ্যাপক সাহেব সারা জীবন প্রায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এই মসজিদে জামাতে আদায় করতেন এবং দীর্ঘদিন এই মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। এতদ্বঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি। আমাদের একান্ত আরজি- ‘তাঁর দাফন মসজিদের সামনে খালি জায়গায় করা হোক। ’

এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অধ্যক্ষ সাহেবের কোন হাত নেই জেনেও সঙ্গীয় ফারুকসহ সকলের দিকে তাঁকিয়ে ঘন্টাখানেক আগে কলেজের মিটিং এ নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। ইমাম সাহেবও কথাটি শুনলেন। মহৎ সিদ্ধান্তের কথা শুনে মনে মনে খুশী হলেন এবং নিজের প্রস্তাবে সম্মতি আদায়ে জনমত সৃষ্টি করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের মুখে কলেজ প্রাঙ্গনে দাফনের সিদ্ধান্তের কথা শুনে ফারুকের পুরনো স্বভাবের বহিঃ প্রকাশ ঘটতে বিলম্ব হলো না। কঠিন সুরে বলে ফেললো- ‘‘কি ব্যাপার দাদা, কলেজে কি আজকাল ফেরেস্তার আনাগোনা শুরু হয়েছে?”

অধ্যক্ষ মহোদয় ফারুক বা ইমাম সাহেব কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না। সোজা চলে গেলেন অধ্যাপক সাহেবের বাড়ীতে। অন্যান্যরাও তাকে অনুসরণ করলো। তাদের দেখে অধ্যাপক সাহেবের দুই স্ত্রী আবারও গভীর শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করলেন। চারদিকের আকাশ বাতাস ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। আমেনা বেগম তার স্বামীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাতে অনুরোধ করে যে পাপ (?) করেছেন তার জন্য বিলাপ করতে থাকলেন। ওদিকে অধ্যক্ষ মহোদয় সকল ভুলের জন্য নিজেকে দোষ দিতে থাকলেন। মসজিদের মাইকে ক্বোরআন তেলাওয়াত ক্রমান্বয়ে দূর থেকে দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। পশু-পাখি পর্যন্ত স্তম্বিত হয়ে গেল।

ওদিকে ঢাকা থেকে কখন লাশ আসবে তা কেউ জানতে পারেনি। মতিন সাহেব ও হক সাহেবকে তখনও পাওয়া যায়নি। প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা ধরে তাদের মোবাইলে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। ফারুক একটু দ্বিধাগ্রস্থ ছিল। তখন থেকেই অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামসুল হক সাহেব মোবাইল রিসিভ করলেন।

‘হ্যালো, ফারুক ভাই, মাফ করবেন। গত দুই দিন ঘুম, নাওয়া-খাওয়া কিছুই ছিলনা। মতিন সাহেব ও আমি দু’জনেই হাসপাতালের সোফার উপর ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এই মাত্র ডাক্তার সাহেব আমাদের ডেকে তুলে সুসংবাদ দিয়ে গেলেন। স্যারের অবস্থা ভালো। এখন জ্ঞান ফিরেছে। সুস্থভাবে কথা বলছেন। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কেবিনে নিয়ে আসবেন। তখন আপনাদের সাথে স্যারকে কথা বলিয়ে দেব। আপনি দয়া করে ভাবী ও প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে খবরটা দিবেন।’

উচিত কথা বলতে ফারুক যেমন সিদ্ধহস্ত মনের দিক থেকে তার চেয়ে বেশী কোমল। তাই কান্না হাসি মিলিয়ে আর একবার চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। আমেনা বেগম দৌঁড়ে ঘর থেকে বাইরে এলেন।

ফারুক- ‘আপনারা সবাই শান্ত হোন। স্যার সুস্থ আছেন। কিছু সময় পর তাঁর সাথে কথা বলতে পারবেন।’
উপস্থিত সকলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকলেন। মুখে বললেন-‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ’। মসজিদের মাইকে ক্বোরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে অধ্যাপক সাহেবের সুস্থতার খবর প্রচার হতে থাকলো। এলাকা জুড়ে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে যেতে থাকলো। আমেনা বেগম বললেন- ‘আমি জানতাম এভাবে তিনি যেতে পারেন না। তার বংশে আল্লাহ কারো অর্থকড়ি দেয়নি; তার বদলে বেশী বেশী আয়ু বরাদ্দ করেছেন। আল্লাহ- তোমার বিচার আছে।’

সবকিছু দেখেশুনে অধ্যক্ষ মহোদয় কলেজে যাবেন, না বাড়ীতে যাবেন ভেবে পেলেন না। ইতোমধ্যে অধ্যাপক সাহেবের সুস্থতার সংবাদ কলেজসহ সমস্ত এলাকায় বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছে। শুধু অধ্যক্ষ মহোদয় কলেজে না গিয়ে বাড়ী ফেরার সিদ্ধান্তই নিলেন। পরদিন সকালে কলেজের অফিস সহকারী মোঃ তোরাব আলী অধ্যক্ষ মহোদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। সময় পেরিয়ে যায় কিন্তু তিনি কলেজে আসেন না। শেষ পর্যন্ত গতকালের দেয়া খামটি খুলে দেখতে পান তাতে অধ্যক্ষ মহোদয়ের পদত্যাগ পত্র। পদত্যাগের কারণ সকলেই বুঝতে পেরে বললেন- ‘উপযুক্ত কাজ করেছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মহোদয়। একদিন আমরাও …………..।’

প্রায় মাস খানেক ঢাকায় থাকার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে অধ্যাপক সাহেব মতিন সাহেবের গাড়ীতে করে বাড়ী ফিরলেন। প্রথমে বাজারে নেমে তার গড়া সোনামুখ ভবনে গেলেন। সেখানে তার প্রাণপ্রিয় সংগঠনের ছেলেমেয়েরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। সামান্য ক্ষোভে দীর্ঘদিন সংগঠনের বাইরে থাকার পর ফারুকও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে অধ্যাপক সাহেবকে অভ্যর্থনা জানাতে। সকল প্রতীক্ষা ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অধ্যাপক সাহেব সেখানে হাজির হলেন। উপস্থিত সকল ছেলেমেয়ে ও ফারুক তাঁকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উল্লাস করতে থাকলো। অধ্যাপক সাহেব অতীতের অনেক স্মৃতি মনে করে মুখ ফুটে বলে ফেললেন- ‘আল্লাহর কাছে লাখো শোকর। আমি এখন তোমাদের মতো পঁচিশ বছরের যুবক। আবার সকলে মিলে লক্ষ লক্ষ সোনামুখ গড়ব। সমস্ত দেশটাকে সোনামুখের দেশ বানাবো।’ তাঁর সেই পুরনো শিশুসুলভ কথা শুনে সকলে আবার উৎফুল্ল হয়ে পাঁজা কোলা করে নিয়ে গেল প্রাণ প্রিয় আমেনা বেগমের কাছে। পরবর্তী দৃশ্য আর বর্ণনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

 

খুলনা গেজেট / এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!