নারীদের সম্মান এবং নারীদের অধিকার, এ দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বহু আলোচনা, সমালোচনা বহুকাল থেকেই হয়ে আসছে। কেউ বলেন, নারীরা সম্মানের, মায়ের জাত, আদরের বোন, তাই তাদেরকে গৃহেই মানায়। কথিত আছে, আল্লাহপাক বলেছেন, “মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত”। সেই মর্মে ডাক্তার নায়েক পর্যন্ত মাতাকে ডায়মন্ড, স্বর্ণ, রৌপ্য, সব ধরনের সম্মাননা দিয়ে পিতাকে কেবল সান্তনা পুরষ্কারে ভূষিত করে নারীর জয়গানে মুখরিত। এমন কি নারীদের নির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থার মধ্যেই রয়েছে বেহেস্তের চাবিকাঠি। এই যেমন নামায, পর্দা, স্বামী সেবা, সন্তান পালন, সাংসারিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এগুলো একটু শরীয়ত মোতাবেক করলেই মেয়েদের আর কি চাই। একেবারে সোজা বেহেস্ত। কি প্রয়োজন ঘর থেকে বেরিয়ে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘষ্টাঘষ্টি করা। একে তো বেকারত্বের কারণে যুবকরা নেশাগ্রস্ত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে, সেখানে মেয়েদের চাকরী করার কি দরকার? সংসারেই তাদের সঠিক স্থান, সেখানেই তাদের মানায়।
অপরদিকে নারীবাদীরা সোচ্চার, “নারীকে ঘরে বন্দী করে রাখলে জাতির কখনই উন্নয়ন সম্ভব নয়।” তাছাড়া যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পীকারসহ সাংসদ থেকে বহু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন নারী দ্বারা সুরক্ষিত। সেখানে গৃহাস্থলীর সুখ-শান্তি কর্ম নিপুণতার দোহাই দিয়ে নারীকে গৃহবন্দী করে রাখলেই হবে? না না এ কখনই হতে পারে না। সেই কোন্ আমলে বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, শকটের দুই চাকাই সমান হতে হবে। এমন কি কবি নজরুলের আমলেও নারীকে লক্ষ্য করে কবি বলেছেন,
‘এ বিশ্বের যা কিছু মহান চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’
আর এখন তো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এখনতো নারীকে গৃহে বেঁধে রাখার কোন সুযোগই নেই। নারী এখন নারী-উদ্যোক্তা, নারী-ক্ষমতায়ন, নারী-স্বাধীনতার মহাপরাকাষ্টার কীর্তিতে মহিয়ান। সেখান থেকে কে তাকে এখন নামায়? আর তা বলার সাহসই বা কোথায়, ‘নারী তুমি গৃহের শোভা, চাঁদের আলো, মনের চাওয়া-পাওয়া।
বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গেছে, “নারী-পুরুষের বৈবাহিক জীবন এখন হুমকির মুখে। ডিভোর্সের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। মতবিরোধ, নারী-নির্যাতন (অনেকে আবার পুরুষ নির্যাতনের কথাও বলতে চেষ্টা করেন), ধর্ষণ, মাদকাসক্তি, ক্রাইম, প্রভৃতি এখন ঘরে ঘরে দুষ্ট ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে নারীদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
তবে কি নারী হাত-পা গুটিয়ে ঘরেই বসে রইবে? ঘরের চৌহদ্দিই তার চলাচলের একমাত্র সীমানা? স্বামীর পরিচয়ই তার পরিচয়? এই কথা কি এখন কোন নারী, কোন মেয়ের পিতা-মাতা, মেনে নেবেন? মেনে নেওয়া কি খুব সহজ?
প্রযুক্তির বদৌলতে জীবনের গতি এখন কত স্পীডে দৌড়াচ্ছে বলা মুশকিল। ঘরের কাজের বুয়া থেকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান নারী কর্মকর্তার হাতে এখন মোবাইল। সারা বিশ্বের নেটওয়ার্ক এখন সকলের হাতের মধ্যে। কেউ কাউকে মানে না। গৃহিনী থেকে চাকরানীর দাপট এখন অনেক বেশী। তারা ণড়ঁ-ঃঁনব থেকে সবকিছুতে দক্ষ। উপরন্তু ফেসবুক, বিভিন্ন অঢ়ঢ়- যেমন ডযধঃং-ধঢ়ঢ়, সধংংবহমবৎ, ইমো…… প্রভৃতি সহ ঞ.ঠ, এফ এম রেডিও আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন এনজিও, বেসরকারী সংস্থা, ঞঠ চ্যানেলের বদৌলতে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্তের নারীরা আজ স্বাবলম্বী, সচেতন, উচ্চাভিলাষী এবং দক্ষ। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত তাদের আবার বিদ্যের দৌড় খুব বেশী নয়। তাদের ফেরানো আর পঙ্গুর গিরিশৃঙ্গ দর্শন একই কথা।
এর মধ্যে আবার ধর্মভীরু বাঙালী জাতি ধর্মের মহাসমুদ্রে ভাসতে গিয়ে মোহনায় হাবুডুবু খাচ্ছে। এদেরই অধিকাংশ আবার পূণ্য বা বেহেস্ত পাবার আশায় বিশাল ওয়াজ মাহ্ফিলের পর্দার মধ্যে বসে কান খাড়া করে নারীদের বরাতে ‘হুজুর কেবলা’ কি নসীয়ত দেন, সেই আশায় উম্মুখ হয়ে সংসার ফেলে বসে থাকেন। বিশ্বখ্যাত এক ‘ইসলামী চিন্তাবীদ’কে বলতে শুনেছি, “মা ও বোনেরা, পর্দার আড়াল থেকে খরগোশের মত কান খাড়া করে আমার কথা শোনেন” পুরুষ ভাইয়েরা আমি সোবহানাল্লাহ বলতে বললেই সমস্বরে বলে উঠবেন। তবে খবরদার, মা-বোনেরা আপনারা ‘সোবহানাল্লাহ’ যেন বলবেন না।
অর্থাৎ পর্দার আড়াল থেকেও মেয়েদের সমস্বরে সোবানাল্লাহ বলাও নিষেধ। কি কঠোর ব্যবস্থাপনা। অনুশাসনের নিচ্ছিদ্র সতর্কতা। আশ্চর্য হতে হয় সারা বাংলাদেশের নারীরা যেখানে হাটে-বাজারে-মাঠে-ময়দানে, দোকানে, স্কুল-কলেজের গেটে, রাস্তায় মৌ মৌ করছে, সেখানে পর্দার আড়াল থেকে ‘সোবহানাল্লাহ’ বলাও নিষেধ। অথচ এতটুকু অনায়াসেই বলা যেতে পারতো যে “মা ও বোনেরা আপনারা মনে মনে বলেন।”
এমনইভাবে ধর্ম, সমাজ, সংসার নারীদের উপর অযাচিতভাবে অন্যায় ব্যবস্থাপনা চাপিয়ে দেয় যা মহান আল্লাহপাক আমাদের উপর নাজিল করেননি। ঝুড়ির তলা খালির মত নারীদের জীবন এখন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য এবং দিশেহারা। না ধর্ম, না সমাজ, না সংসার কোন স্থানেই নারীরা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
একজন মুফতি বলছেন, “বোনেরা, আপনারা স্বামীদের উপর তাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের কিছু দেওয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, হস্তক্ষেপ করা পর্যন্ত বিষয়টি যাবে কেন? নবীজী (সাঃ) উম্মুল মুমিনদের অন্যায় আবদার কি মেনে নিয়েছেন? তাছাড়া সতর্ক কেবল স্ত্রীদের করা হবে কেন? স্বামীদের বলা হয় না কেন, তোমরা স্ত্রীদের সীমানা বুঝিয়ে দেবে তারা যেন তোমার বাবা-মার বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। এক তরফা সব মেয়েদেরকেই বলা হয় কেন?
নারীর সম্মান আল্লাহপাক যেভাবে দিয়েছেন সেভাবে আজ পর্যন্ত নারীরা পায় না বিধায় তারা ঘর থেকে পথে পথে ‘অধিকার’ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ‘ভরণপোষণ’ নয় নারীর দাবী আত্মসম্মান এবং স্বনির্ভরতা। সেইখানে জোটে অনাদর এবং পরমুখীতার গ্লানি। তাই নারীদের অধিকার এবং সম্মান এই দুটি বিষয় এখনও অস্বচ্ছ এবং অমলিন। এখানে একান্তভাবে গবেষণার প্রয়োজন।
আমরা সংরক্ষণশীল বাঙালী। উপরন্ত অধিকাংশ মুসলিম নারী পর্দানশীল। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, এমন কি আলোকপ্রান্ত উপজাতীয়দের মধ্যেও মূলতঃ শালীনতা রয়েছে। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। তাই নারীদের কি অধিকার এবং কোথায় তাদের সম্মান, এটি আজও অমীমাংসিত এবং দূর্বোধ্য। এখানেও আরও চর্চা হওয়া দরকার। ৮ মার্চের ‘নারী-দিবস’ তখনই সার্র্থক হবে, যখন ধর্ম-বর্ণ-ভাষার উর্ধ্বে সকল নারীদের অধিকার ও সম্মান সুরক্ষিত হবে।
(লেখক : কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, খুলনা)
খুলনা গেজেট/এমএম