পরিবারের অভাব-অনটনে শিক্ষা গ্রহণ থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একটি বইয়ের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া ছিল অসম্ভব। সেই মানুষটিই এখন শিক্ষার আলো ছড়ান। এ কাজে কাটিয়েছেন ২৮টি বছর। তিনি পিঠাভোগ ডি জি সি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ রায়।
কৃষ্ণপদ রায় ১৯৭১ সালে খুলনায় রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের পিঠাভোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর ও বর্গা চাষী। ছোটবেলায় ৭/৮ বছর বয়সে মা মাকে হারান। অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শিক্ষা জীবন। প্রাইমারিতে একটি বইয়ের অভাবে পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছিল না, তখন তাঁর চাচারা অনেক কষ্টে বইটির ব্যবস্থা করেছিল।তিনিও ভাল রেজাল্ট করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ইচ্ছা থাকলেও প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারতেন না।কারণ সপ্তাহে ২/৩ দিন অন্যের জমিতে বা পানের বরজে দিনমজুরির কাজ করে অভাবের সংসার ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হয়েছে। এভাবে লেখাপড়া করে তিনি মানবিক বিভাগে কাজিদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর খুলনায় সুন্দরবন কলেজে ভর্তি হন। কলেজে যাতায়াতের জন্য কোন অর্থের ব্যবস্থা না থাকায় সপ্তাহে ১/২দিন কলেজে যাওয়া সুযোগ হতো। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালে এইচএসসি পাশ করেন। কলেজ থেকে মাত্র দুইজন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল তার মধ্যে তিনি একজন। পরবর্তীতে অনার্সে বিএল কলেজে ইংলিশে সুযোগ হয়েছিল কিন্তু অর্থ কষ্টে অনার্স পড়া সম্ভব হয়নি। পরে সুন্দরবন কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। সেখানে ভালো ফলাফল করেন।
শিক্ষক কৃষ্ণপদ রায় বলেন, অধ্যায়নরত অবস্থায় গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে যে অর্থ উপার্জন করতেন তা সংসারে ব্যয় হতো। শিক্ষার্থীদের তিনি ইংরাজি ও অংক বিষয়ে পড়াতেন। সেখান থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেন শিক্ষকতা পেশায় আসার। পিঠাভোগসহ পার্শবর্তী গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র। তারা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলে পাঠাতেন না। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুতে এলাকার গুণীজনদের সাথে কথা বললে। সেই ডাকে সাড়া দেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা মুকুল চন্দ্র হালদার, জমিদাতাদের মধ্যে বিবেকানন্দ রায়সহ আরো অনেকে, আর্থিক সহযোগিতায় চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বাদশা। ১৯৯৩ সালের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ১৯৯৮ সালে জুনিয়র পর্যায়ে এমপিও ভুক্ত হয়। ২০০০ সালে মাধ্যমিকের আবেদন মঞ্জুর করে ২০০৪ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এমপিও ভুক্ত হয়। স্কুলের ক্লাস শেষে নিয়মিত গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য বিদ্যালয়ে আসার জন্য বলতাম। আস্তে আস্তে ছেলে-মেয়েরা স্কুলমুখী হতে শুরু করলো। গ্রামে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পড়া ক্লাসে শেষ করাতেন। যারা দুর্বল শিক্ষার্থী ছিলেন তাদেরকে আলাদাভাবে পড়াতেন। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান ৫/৬ বার উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশের হার শতভাগ। উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছি ৬ বার। তিনি শিক্ষকতাকে আদর্শ ও মহৎ পেশা হিসাবে বুকে ধারণ করেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন একই স্কুলে শিক্ষকতা করি। আমার সর্বপ্রথম স্বল্প বেতন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। আমার স্ত্রী লক্ষ্মী রানী রায়ের নিয়োগ ২০০১ সালে এবং বেতন শুরু ২০০২ সাল থেকে। এসএসসি পাশ করার পর অনেকে কলেজ ও কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না টাকার অভাবে। তাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন তিনি। সর্বদা শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেন। বর্তমানে তার অনেক ছাত্র ভালো অবস্থায় রয়েছে।
অভিভাবকরা জানান, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হওয়ায় অনেক ঝড় ও প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন তিনি। মামলার শিকার হয়েছিলেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু লোকের কারণে।
বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও সকাল বিকেলে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রিয় প্রতিষ্ঠান। এরপর ছুটে যান নিজের মাছের ঘের ও সবজি ক্ষেতে।
এই শিক্ষক বলেন, কোচিং একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা কেন জানি না বুঝে সারাদিন কোচিং কোচিং করে মাথা নষ্ট করে। ক্লাসের পড়া ক্লাসে শেষ করলে কোচিং এর প্রয়োজন হয় না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চান তিনি।
খুলনা গেজেট/কেডি