শনিবার । ২৯শে নভেম্বর, ২০২৫ । ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

জয়ের নতুন আবিষ্কার, বিদেশ থেকে আ.লীগ-বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে

গেজেট প্রতিবেদন

বাংলাদেশের বড় দুটি দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে একটি অগণতান্ত্রিক তৎপরতা রয়েছে বলে দাবি করেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, দুই দলেরই নেতৃত্ব পরিবর্তনে ‘বিদেশ থেকে একটা খেলা চলছে’।

বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বড় দল বলতে তিনি বিএনপিকে বুঝিয়েছেন। তবে খেলা বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছেন এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা স্পষ্ট করেননি। তার দলের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার পর তাদের পরিবারের কারো সরাসরি হাল ধরার সম্ভাবনাও নাকচ করেছেন সজীব ওয়াজেদ।

শেখ হাসিনার অবর্তমানে কিংবা তার মায়ের পরে তিনি দলের নেতৃত্বে আসতে চান কি না, এ প্রশ্নে জয় বলেন, দলই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কে হবে, এটা দল নির্ধারণ করবে। আমি বা অন্য কেউ এটা ওপর থেকে নির্দেশ দিতে পারি না। যেটা এখন চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে দুই দলেরই নেতৃত্ব পরিবর্তন করার ওপর থেকে বিদেশ থেকে একটা খেলা চলছে। এটা গণতান্ত্রিক না।’

‘রিফাইন্ড’ ধারণা নিয়ে সন্দেহ
গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতিতে বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের দায়িত্বশীল অধিকাংশ নেতাই দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে অথবা কারাগারে আছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার পর রাজনীতিতে তার ভবিষ্যত ও আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন কারো নেতৃত্বে একটি ‘রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ’কে রাজনীতিতে সক্রিয় করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ ধারণার বিপক্ষে কঠোর একটা মনোভাব আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুগত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে।

একটা রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ নিয়ে যে আলোচনা আছে, সেটা কীভাবে দেখেন এ প্রশ্নে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই ওয়ান ইলেভেনের সময়ের যে বিষয়টা।’ তখনো রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ, বিএনপি আলেচনায় এসেছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বড় দল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দুই দলেরই কেবল নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক আছে, যা দেশের বাকি কোনো দলের নাই। বাংলাদেশে ক্ষমতায় এলে বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ এই দুই দলের একটি আসবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ বাস্তবতায় কাদের ইচ্ছায় রিফাইন্ড এই প্রশ্ন তুলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘বিদেশি কয়েকটা দেশ, বিদেশি কয়েকটা শক্তি আর আমাদের সুশীল সমাজের কয়েকজন মিলে নির্ধারণ করবে যে কে প্রধানমন্ত্রী হলে রিফাইন্ড হবে, কে নেতা হলে রিফাইন্ড হবে।’

বাংলাদেশের জনগণ এরকম কিছু চায় কি না, এই প্রশ্ন তোলেন সজীব ওয়াজেদ।

রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের যে আলোচনা হচ্ছে সেটার ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে নির্ধারণ করা হবে যে আওয়ামী লীগকে ফিল্টার করে কে যোগ্য নেতৃত্ব, আমরা বেছে দেব। মানুষের ভোটে না, নেতাকর্মীদের ভোটে না। সেটাই হচ্ছে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র। তো রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ, বিএনপি এসবে আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস গণতন্ত্রে। দল নির্ধারণ করবে যে দলের নেতৃত্ব কে দেবে, দেশের মানুষ নির্ধারণ করবে যে দেশের নেতৃত্ব কে দেবে।’

আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্ব
বর্তমানে ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এই নেতৃত্ব পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা বা আলোচনাও নেই। দেশের মধ্যে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার পরিবেশ নেই বলেও মনে করছে আওয়ামী লীগ।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, দলের নেতৃত্ব তো এখনো আছে। তিনি বলেন, ‘দলের সভাপতি হচ্ছেন আমার মা। উনাকে তো দলের নেতাকর্মীরাই সমর্থন করে রেখেছেন। কেউ উনাকে ছেড়ে যায়নি। হ্যাঁ, তারা বিচ্ছিন্ন আছে, তবে তারা কিন্তু ঐক্যবদ্ধ আছে। তো দলের নেতৃত্ব এখনো ইনট্যাক্ট আছে। আমাদের দল সম্পূর্ণভাবে ইউনাইটেড আছে।’

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের হয়ে বিদেশে সজীব ওয়াজেদ জয় নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। দলের নেতৃত্বে আসবেন কি না বিবিসি বাংলার এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটাও তার নিজের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আমি আসলে সরাসরি কোনো দিন রাজনীতি করতে চাইনি। বাট এখন যে খেলা চলছে তাতে কী হবে, তা তো কেউ বলতে পারে না। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে নিজে নির্ধারণ করতে হবে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্ধারণ করতে হবে।’

দলের বর্তমান পরিস্থিতি ও সংকট স্বীকার করে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা নেতৃত্ব দেওয়া নয়, বরং তার ভাষায় দেশে গণতন্ত্র ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা।

বাংলাদেশে এবং আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের সংকট কীভাবে পূরণ হবে, সে বিষয়ে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘নেতৃত্বের সংকট পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। আমাদের যত নেতা আছে, তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে রাখা হয়েছে, এখন দেড় বছর ধরে তারা জেলে। বাকিদের জেলের ভয়ে দেশ ছেড়ে থাকতে হয়েছে।’

শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বে কে আসবেন, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার কোনো ধারণা দেয়নি, গত ১৫-১৬ বছরেও এ বিষয়টি সামনে আনা হয়নি। এখনো এটি স্পষ্ট নয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, সেটিও দলীয় ফোরামে সেভাবে আলোচিত হয় না বলেই নেতাকর্মীরা বলছেন। এখনো আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ আছে বলে দলের একটা বড় অংশ মনে করছে।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটা গণতান্ত্রিক দল। আমরা তো একটা রাজত্ব না যে আমরা নির্ধারণ করে দেব, কে নেতৃত্বে আসবে, কে আসবে না। একমাত্র কিন্তু আওয়ামী লীগ একমাত্র দল যে কখনো বলে নাই যে শেখ হাসিনার পর কে আসবে। এটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি। ওপর থেকে বসানো কিছু আমরা মানি না। আমরা নিজেদের নেতাকর্মীদের ওপর ভরসা করি, নিজেদের গণতন্ত্রের ওপর ভরসা করি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা কেউ জানে না কে আসবে, কে নেতা হতে চাইবে। সেটা আমাদের দলের যখন কাউন্সিল হয় সেখানেই কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। আমরা কিন্তু নিজেদের দলের ভেতর নির্বাচন করি ব্যালট দিয়ে, সেখান থেকেই কিন্ত আমার মাকে দল প্রত্যেকবার সভাপিত নির্বাচিত করেছে।’

অতীতে শেখ হাসিনা তাকে নেতৃত্ব গ্রহণের বিষয়ে বিবেচনা করতে বলেছেন বলে দাবি করেন সজীব ওয়াজেদ। তার ভাষায়, দলে কেউ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় না।

জয়ের ভাষ্য, ‘সবাই উনাকেই চায়। হ্যাঁ, অনেকেই আমাকে বলেছেন বার বার আসতে, আমার মাও আমাকে অনেকবার বলেছেন গত ৫-১০ বছরে। তবে আমি চাই যে এটা আমরা সবাই চাই যে সময়মতো সেটা দল বেছে নেবে। দল যাকে চাবে, সে দাঁড়াবে, তারা দাঁড়াবে। দলের ভেতর নির্বাচন হবে, যে বেশি ভোট পাবে সে দলের সভাপতি হবে। সেটাই আমরা চাই।’

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামটিও আলোচনায় আছে তৃণমূলে। শেখ রেহানা ও তার ছেলে মেয়েরাও দলের নেতাকর্মীদের ভাষায় ‘বঙ্গবন্ধু’ পরিবারের সদস্য।

শেখ পরিবারের সদস্যদের নেতৃত্বে আসার প্রসঙ্গে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘আমরা আমার পরিবার আমাদের সবাই ৩০ বছর ধরে বিদেশে। আমরা সবাই বিদেশে স্ট্যাবলিশ। আমরা সবাই পড়ালেখা করেছি। আমার পরিবারের পাঁচ ভাই-বোন আমাদের সবার মিনিমাম মাস্টার্স আছে। আমাদের বিদেশে আয় আছে, বিদেশে আমরা শান্তিতে থাকি। রাজনীতি করতে হলে রাজনীতির একটা ইচ্ছা থাকতে হয়। আমাদের পরিবারের টিউলিপের রাজনীতি করার ইচ্ছা ছিল, সে রাজনীতি করেছে ইংল্যান্ডে, ব্রিটেনে। বাংলাদেশে করেনি কখনো।’

সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আসার সম্ভাবনা কতটা এ প্রশ্নে জয়ের ভাষ্য, এ নিয়ে আলোচনা আছে, তবে বাস্তবতা ভিন্ন।

তিনি বলেন, ‘আমার বোনকে নিয়ে যে চিন্তা করা হয়। আমার বোনের আসলে রাজনীতিতে সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই, আমি যতদূর জানি। এটা অনেকেই ভাবছে তবে এই ধারণাটা ভুল।’

৫ আগস্টের পর পরিবারের মধ্য থেকে দলীয় নেতৃত্বের বিষয়টি নিজেদের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে বলেও জানান জয়। তার দাবি, পরিবারের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ বলেই সবাইকে মামলা দিয়ে সাজা দেওয়া হচ্ছে যাতে নির্বাচনে অযোগ্য করা যায়।

জয়ের দাবি, ‘তারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করছে যাতে আমাদের কনভিক্ট করতে পারে, যাতে আমরা নির্বাচন করতে না পারি। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু এইটা, আমরা কেউ যাতে নির্বাচন করতে না পারি।’

প্রসঙ্গত, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে করা তিন মামলায় শেখ হাসিনাকে ২১ বছরের কারাদণ্ড এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।

জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগ কি জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে, এ প্রশ্নে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘ক্ষমা চাইলেই কি তারা সবকিছু ছেড়ে দেবে? তবে হ্যাঁ, গত জুলাইয়ে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সরকারের ভুল হয়েছে। সেটা আমরা সবসময় বলে এসেছি। শুরুর দিকে আন্দোলনে ভুল হয়েছে। পরেও ভুল হয়েছে। সেটার তো স্পষ্ট তদন্ত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমার মা তখন প্রধানমন্ত্রী, তিনি ৫ আগস্টের আগে একটা জুডিশিয়াল কমিশন করেছিলেন সব হত্যার তদন্ত করতে। কারণ হত্যা তো শুধু ছাত্র এবং সাধারণ জনতার হয় নাই, পুলিশের হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। সেটারতো স্পষ্ট একটা তদন্ত করতে হবে যে সেটার জন্য কে দায়ী।’

জয়ের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকার জুলাই আন্দোলনের সময় অনেক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘হ্যাঁ, ভুল হয়েছে। তবে সেখান থেকে যদি বিচার করতে হয়, ক্ষমা চাইতে হয়; ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জন্য তো ইউনূস সরকার ইনডেমনিটি দিয়েছে। আপনি এক হাতে বলছেন যে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাইতে হবে। আবার হাতে বলছেন যে যারা পুলিশ হত্যা করেছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা করেছে, তাদের খুন সব মাফ; সেটা কীভাবে হয়। সেটাই যদি হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়ার কী আছে?’

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন