মঙ্গলবার । ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২

সংকট অব্যবস্থাপনায় বন্দি নড়াইলের স্বাস্থ্যসেবা

এসকে সুজয়, নড়াইল

হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়ি, মেঝে সবখানেই রোগীদের ভিড়। বহির্বিভাগে লম্বা লাইন, জরুরি বিভাগে করুণ আর্তনাদ, আর ওয়ার্ডে ঠাঁই না পেয়ে মেঝেতে শোয়া অসুস্থ মানুষ। এমন নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই চলছে নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকটে এখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ চরম বিপর্যস্ত।

প্রায় ৮ লাখ মানুষের ভরসাস্থল ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দুইশ’ থেকে তিনশ’ রোগী ভর্তি থাকেন। এর বাইরে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে আরও ৬০০-৭০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন প্রতিদিন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, অনুমোদিত ৩৯ চিকিৎসক পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত মাত্র ১৬ জন। সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, চক্ষু, নাক-কান-গলা, রেডিওলজি, চর্ম ও যৌনরোগসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এমনকি প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্টের পদও বহু বছর ধরে খালি।

অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) কার্যত চলছে ‘জোড়াতালি’ দিয়ে সেবা। গাইনি বিভাগের দুটি ওটি টেবিলই অচল অবস্থায়, অটোক্লেভ মেশিন, ডায়াথার্মি, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন এমনকি ওটি লাইটও অকেজো। বাধ্য হয়ে জেনারেল ওটি থেকে ধার করা লাইট ও সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা।

#আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন দীর্ঘদিন অকেজো, নেই কোন প্যাথলজিস্ট।

#অপরিচ্ছন্নতা আর মশার উপদ্রবে রোগীর স্বজনরা হয়ে পড়ে অসুস্থ।

দু’টি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনও বহু বছর ধরে অকেজো। ফলে রোগীদের প্রায় সবাইকে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে টেস্ট করাতে হচ্ছে।

সদর উপজেলার হবখালী গ্রামের বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুন (৬৫) বলেন,“সকাল থেকে লাইনে আছি, এখনও ডাক্তার পাইনি। এত ভিড় যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চেয়ারও নেই মেঝেতে বসে আছি।”

নড়াইল পৌর এলাকার ভাদুলিডাঙ্গা গ্রামের সুজন বিশ্বাস বলেন, “আমার মা ভর্তি, কিন্তু ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় বারান্দায় বিছানা পেতে রাখা হয়েছে। রাতে মশা আর দুর্গন্ধের কারণে একটুও ঘুম হয় না।”

লোহাগড়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সিমা খাতুন বলেন, “হাসপাতালের অবস্থা এমন যে, বাথরুমে ঢুকলেই বমি আসে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে অসুস্থ রোগী আসলে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। দুর্গন্ধ, নোংরা পানি আর ময়লার স্তুপে থাকা মনে হয় যেন শাস্তি ভোগ করা।”

কালিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মো. রুবেল মিয়া অভিযোগ করে বলেন, “ডাক্তারদের দেখা মেলে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, পরে বলা হয় ডাক্তার রাউন্ডে গেছেন। হাসপাতালে এসে চিকিৎসার চেয়ে হয়রানিই বেশি হয়।”

চিকিৎসা নিতে আসা রোকসানা আক্তার বলেন, “ওয়ার্ডে জায়গা নেই, বারান্দায় শুয়ে থাকতে হয়। রোগীর পাশে আত্মীয়দের বসারও জায়গা নেই। রাতে মশার উপদ্রব এমন যে ঘুমানো যায় না।”

অন্যদিকে, রোগীর স্বজন মিশকাত বলেন, “সরকারি হাসপাতালে সাধারণ মানুষ একটু সেবা পাবে এই আশায় আসি। কিন্তু এখানে তেমন কোন ওষুধ পাওয়া যায় না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর সেবার মান দুটোই করুণ।”

নড়াইল শহরের জাহিদুল ইসলাম (৪০) একজন দিনমজুর।তিনি বলেন, “প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে টাকা লাগে হাজার হাজার। তাই এখানে আসি, কিন্তু ওষুধের অর্ধেকই বাইরে থেকে কিনতে হয়।”

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ আব্দুল গফ্ফার বলেন, “বরাদ্দের বিপরীতে অর্ধেকেরও বেশি চিকিৎসক পদ শূন্য থাকায় বিশাল রোগীর চাপ সামলানো কঠিন। তারপরও আমাদের চিকিৎসক ও কর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।”

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন