শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

শহীদ সাংবাদিক অধ্যাপক খালেদ রশীদ

কাজী মোতাহার রহমান

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে খুলনায় নয় মাসে সংগ্রামী মানুষের ত্যাগ-তীতিক্ষা ও স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রামী বীর শহীদ অধ্যাপক খালেদ রশীদের নাম। খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা ১৭ ডিসেম্বর উত্তোলন করা হয়, এই পার্কের শহীদ মিনারে ভিত্তিস্থাপনকারী ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে তিনি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পাক-চীন মৈত্রী সমিতির খুলনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য। খুলনার বাইতিপাড়া এলাকার তালতলা রোড থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সেতু’ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘সন্দীপন’ নামের মাসিক পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। হতদরিদ্র পরিবারের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে জনমত গঠনের লক্ষ্যে এ পত্রিকা দু’টিতে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ছাপা হতো। ছাপা হয় খালিশপুর ও রূপসা অঞ্চলের শ্রমিকদের দুর্দশার কাহিনি। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনই ছিল পত্রিকা দু’টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও বর্গা চাষীদের অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনি প্রকাশ পেত ‘সেতু’ ও ‘সন্দীপন’ পত্রিকার পাতায়। তিনি ‘সন্দীপন’ পত্রিকার ‘আলকেমি’ ছন্দ নামে লিখতেন (ড. শেখ গাউস মিয়া রচিত আলোকিত মানুষের সন্ধানে)। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ূব খান বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ খুলনায় এসে পড়ে। বিশেষ করে ঢাকায় আসাদের মৃত্যুর পর খুলনায় এ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। খুলনা শহরে শহীদ মিনার স্থাপনের দাবি জোরালো হয়। এ দাবি বাস্তবায়ন করতে অধ্যাপক খালেদ রশীদকে আহ্বায়ক করে একুশ উদ্যাপন কমিটি গঠন করা হয়। আগেই বলা হয়েছে স্থানীয় শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ মিনার স্থাপনের তিনিই অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গোলার আঘাতে এ শহীদ মিনার চুর্ণবিচর্ণ হয়ে যায়।

১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে খালেদ রশিদের নেতৃত্বে খুলনার ডুমুরিয়ার শোভনা অঞ্চলে বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু করে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐতিহ্যবাহী শোভনা অঞ্চল। সেখানে জন্ম কৃষক মজুরের সংগ্রামী নেতা মাওলানা আহমদ আলীর। সেই ডুমরিয়ার শোভনা অঞ্চলকে অধ্যাপক খালেদ রশিদ আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বেচে নিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল রেডিয়ো পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্র দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থ অভিযান এবং চুকনগরের পাকবাহিনীর গণহত্যায় ডুমুরিয়ার মানুষ ফুঁসে উঠে। খালেদ রশিদের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনী সদাপ্রস্তুত।

তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুরাহ। পাক হানাদার বাহিনীর দুই/তিনটা গানবোট ডুমুরিয়ার নদীতে টহল দিত। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের চোরা মারের কারণে পাক বাহিনী পিছু হটে যায়। পাকবাহিনী ভদ্র ও কৈয়া নদী থেকে আসে-পাশের গ্রামগুলোর উপর আক্রমণ চলাতে থাকে। শোভনা মুক্ত অঞ্চল হলেও রাজাকার ও পাকবাহিনীর টার্গেট সেদিকটার উপর। পাকবাহিনীর একটি গানবোট চালায় শোভনা গ্রামের উপর। অসীম সাহসিকতার সাথে বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তার প্রতিরোধ করেন। শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীকে বোঝাতো মুক্তি বাহিনীর চেয়েও বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ গেরিলারা সবচেয়ে ভয়ংকর। গেরিলারা সাধারণত পিছু হটতো না। পাক বাহিনী গেরিলাদের হাতে ২/১ বার পরাজিত হওয়ার পর শোভনা এলাকায় গেরিলাদের ঘাঁটি ও অবস্থান জেনে নেয়।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কথা। পাকিস্তানি বাহিনী দুটি গানবোট নিয়ে শোভনা অঞ্চলের গেরিলাদের ওপর আক্রমণ চালায়। গানবোট দু’টিতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। অধ্যাপক খালেদ রশিদের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী মরণপণ রাতভর যুদ্ধ করে। পাক বাহিনীর একটি গুলিতে অধ্যাপক খালেদ রশিদের মৃত্যু হয়। বামপন্থি রাজনীতিক হায়দার আকবার খান রনো লিখেছেন, আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট অংশটির যুদ্ধ প্রসঙ্গে ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। তবুও এই অংশটি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, বিশেষত বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলায়। খুলনা জেলায় আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ যে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মজিদ, আব্দুর রউফ, কামারুজ্জামান লিচু, হাফিজুর রহমান, আজিজুর রহমান ও অধ্যাপক খালেদ রশিদ। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার লাশ পাওয়া যায়নি।

১৯৩৪ সালে সিরাজগঞ্জে তার জন্ম হয়। তার পিতার নাম বাহাদুর সরদার, পেশায় ব্যবসায়ী। খালেদ রশিদ সিরাজগঞ্জ থেকে মেট্রিক পাশ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে খুলনা মহিলা কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদেন। এই কলেজটি সরকারি হলে পদত্যাগ করে সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি উপাধ্যক্ষ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সন্দীপনের মাধ্যমে সারা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রাণ পুরুষ। ১৯৬২ সালে শ্রমিকদের সাথে একান্তভাবে মিশে যখন অবাঙ্গালীরা খালিশপুরে বাঙালি শ্রমিকদের কাচা ঘর ও বস্তিতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় তখন তাদের সেবা করা, সাহায্য ও শীতবস্ত্র দিয়ে তিনি অসহায় শ্রমিক জীবনের সাথে মিশে যান। খুলনা সাহিত্য পরিষদের সাথেও জড়িত হন। পরে সন্দীপন সাংস্কৃতিক সংগঠন স্থাপিত হলে তাতে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন