পাকিস্তান আমলের শেষ সময়টা খুলনার সামগ্রিক রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। উনসত্তরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্বে এমএম সিটি কলেজে ছাত্র রাজনীতি ছাত্রলীগের অনুকূলে বইতে থাকে।
১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত শেখ শহীদুল ভিপি এবং শেখ আজমল হোসেন জিএস নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় একাত্তরের ১ মার্চ। সকাল থেকে ইথারে ইথারে খবর ভেসে আসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
দুপুর একটা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে জাতীয় সংসদে ৩মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা প্রচারিত হয়। বিকেলে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আযম খান কমার্স কলেজ থেকে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল মিউনিসিপাল পার্কে এসে শেষ হয়।
৩ মার্চ স্বাধীনতার দাবিতে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্ক (আজকের শহীদ হাদিস পার্ক) থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জঙ্গি মিছিল বের হয়। ৩ মার্চ বিকেলে ছাত্র সমাজ কালীবাড়ী রোড ও কেডি ঘোষ রোডে কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুট করে। তারা দোকানগুলো থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে। ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা কমিটি গঠন করা হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে।
যুগ্ম আহ্বায়ক মনোনীত হন যৌথভাবে স.ম. বাবর আলী, হুমায়ুন কবির বালু (সিটি কলেজ)। সদস্যবৃন্দ শেখ আব্দুল কাইয়ুম, শেখ শহিদুল হক (সিটি কলেজ), হায়দার আলী, সালাউদ্দিন রুনু, হেকমত আলী ভূঁইয়া (সিটি কলেজ), শাহ আব্দুল কালাম, ফ.ম সিরাজ, মাহবুবুল আলম হিরন, শেখ শওকত আলী ও মিজানুর রহমান। ২৩ মার্চ সকাল ১০টা নাগাদ সাদা পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে জয় বাংলা বাহিনী মিউনিসিপ্যাল পার্কে উপ¯িত হয়। এ সময় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়। খুলনায় এই প্রথম পতাকা উত্তোলন।
পাকিস্তান বাহিনী ২৬ মার্চ সকাল থেকে খুলনা শহরে কনভয় যোগে টহল দিতে শুরু করলে বিপ্লবী পরিষদের সদর দপ্তর খানজাহান আলী রোডের কবীর মঞ্জিল থেকে পূর্ব রূপসায় স্থানান্তর করা হয়। সে সময় রূপসার হামিদা মঞ্জিল ও দেবীপুর গার্লস স্কুল ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি জনমনে সাড়া ফেলে। বেতার কেন্দ্র দখলের সিদ্ধান্ত হয় ৪ এপ্রিল তারিখে। রাত আনুমানিক ৯টা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি গল্লামারীস্থ রেডিও স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যুদ্ধের ৪ এপ্রিল প্রথম প্রহরে রেডিও স্টেশন দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমন শুরু হয়। রেডিও স্টেশনের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে দাদা ম্যাচ ফ্যক্টরির কর্মচারী ঝালকাঠী মহাকুমার রাজাপুর থানার বদনীকাটি গ্রামের আশরাফ আলী খান এর পুত্র হাবিবুর রহমান খান এবং আনসার বাহিনীর সদস্য বাগেরহাট মহাকুমার মোড়েলগঞ্জ থানার উত্তর সুতালড়ী গ্রামের হামেদ আলী হাওলাদার এর পুত্র মোসলেম আলী হাওলাদার শহীদ হয়। সেখান থেকে যোদ্ধারা তার লাশ এনে রূপসার দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে দাফন করে।
যুদ্ধরত অবস্থায় সিটি কলেজ ছাত্রাবাসের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে যুদ্ধের অধিনায়ক শেখ জয়নুল আবেদীন শহীদ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে বিভিন্ন ভাবে ভারতে যেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা হচ্ছেন মোল্লা মোর্শারফ হোসেন (স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্র সংসদের ভিপি, আনন্দনগর, রূপসা), জাহিদুর রহমান জাহিদ (বাগমারা), শেখ শহীদুল হক (স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্র সংসদের ভিপি, শেখপাড়া), এ্যাড. আ.ফ.ম মহাসীন (পশ্চিম টুটপাড়া), নাট্যকার জুল কাদির, শরীফ খসরুজ্জামান (সাবেক সংসদ সদস্য, নড়াইল), হুমায়ুন কবীর মোল্লা (আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর), আব্দুস সামাদ তরফদার (স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্র সংসদের ভিপি, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা), শেখ আফজালুর রহমান (পৈপাড়া, খুলনা), আব্দুস সালাম (পূর্ব বানিয়াখামার), আব্দুস সামাদ (বসুপাড়া), শেখ মহাসীন (নৌ কমান্ড), শেখ মোঃ মিজানুর রহমান (তালা. সাতক্ষীরা), শেখ আতিয়ার রহমান (কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা), ইবনে সিনা ওয়াহিদ মিকি (ডুমুরিয়া, খুলনা), নুরুল ইসলাম মনু (টিবি ক্রস রোড, খুলনা), এস এম ওয়াহিদ উন নবী (হাজী মহাসীন রোড, খুলনা), অধ্যক্ষ শেখ আব্দুল খালেক (চানমারী বাজার, খুলনা), চিত্তরঞ্জন স্বর্ণকার (কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা), জি এম হুমায়ুন কবীর (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা), নুরুল ইসলাম খোকন (কেশবপুর, যশোর), শেখ আব্দুস সাত্তার (টুটপাড়া, খুলনা), খন্দকার আমিন রেজা (শিরিশনগর, খুলনা) নজরুল ইসলাম ইজারাদার (জিন্নাহপাড়া, খুলনা), এস এম জিয়াউল ইসলাম (ডুমুরিয়া, খুলনা), শেখ আবুল কাশেম (যাত্রাপুর, বাগেরহাট), আব্দুর রহমান সানা (কয়রা, খুলনা), শিকদার আনোয়ারুল ইসলাম (লোহাগড়া, নড়াইল), শেখ আজমল হোসেন (পাইকপাড়া, বাগেরহাট) গোলাম রব্বানী, জি এম মাওলা বক্স (কয়রা) ও শামসুর রহমান খান (পিরোজপুর)।
স্বাধীনতা পূর্বকালে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ আজমল হোসেন ৪ এপ্রিল গল্লামারী রেডিও সেন্টার দখরের যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়। এ অবস্থায় তিনি গ্রামের বাড়ীতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২ অক্টোবর ফকিরহাট উপজেলার সাতশিকা গ্রামে রাজাকার তাকে হত্যা করে। তিনি এ কলেজের গর্ব।
খুলনা গেজেট/এনএম

