শনিবার । ১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ৩০শে কার্তিক, ১৪৩২
১৮ বছর পরও শরণখোলাবাসীর মনে ভয়ংকর রাতের দুর্বিষহ স্মৃতি

বলেশ্বরের তীর রক্ষাবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আজ ১৫ নভেম্বর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৮ বছর। ২০০৭ সালের এই দিনে দানব-রুপি সিডর লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল উপকূল। সেই রাতের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের শরণখোলা পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। প্রাণ হারিয়েছিল সহস্রাধিক মানুষ।

সেদিন রাতের সেই বিভীষিকা আজও ভুলতে পারেনি শরণখোলার মানুষ। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তেই ভেসে গিয়েছিল মানুষের বসতঘর, গবাদিপশু, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসল। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সবখানেই শোনা যাচ্ছিল স্বজনহারা মানুষের বিলাপ। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় সিডরের আঘাতে নাজুক বাঁধ ভেঙে বলেশ্বর নদের জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় শরণখোলার জনপদ।

সিডরের প্রায় ৯ বছর পর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারে মোট ৬২ কিলোমিটার উঁচু বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে বলেশ্বর নদের তীরে শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী থেকে মোরেলগঞ্জ উপজেলার সীমানা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মিত বাঁধের পরিমাণ প্রায় ২০ কিলোমিটার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় এই বাঁধ নির্মাণের কাজ। ‘সিএইচডব্লিউই’ নামের চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাস্তবায়ন করে। তিন বছরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে প্রকল্পটি শেষ হতে সময় লাগে প্রায় সাত বছর। কাজ শেষে ২০২৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বাঁধটি হস্তান্তর করে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু হস্তান্তরের দুই বছর যেতে না যেতেই বাঁধটি ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। বলেশ^র নদের তীর রক্ষাবাঁধের ২০ কিলোমিটারের বেশিরভাগ এলাকাতেই ভয়াবহ ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। অন্তত ১১টি স্থানের সিসি ব্লক ধসে মূল বাঁধেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণে ত্রুটি এবং নদী শাসন না করে নির্মাণের ফলে বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাঁধের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে শরণখোলার বলেশ্বর পাড়ের মানুষের মনে জেগে ওঠে সিডরের সেই ভয়ংকর রাতের দুর্বিষহ স্মৃতি।

এমন ভয়াবহ ভাঙন দেখে শরণখোলাবাসীর আক্ষেপ, সিডরের ১৭ বছর পরও বাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। আতঙ্কে দিন কাটছে বলেশ্বর নদের তীরের বাসিন্দাদের। নদ-তীরবর্তী গাবতলা গ্রামের বাসিন্দা মিজান হাওলাদার, দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের আলমগীর হোসেন, জাহাঙ্গীর খান, উত্তর সাউথখালী গ্রামের আনোয়ার হাওলাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ ছিলো না বলে সিডরে আমরা স্বজন হারিয়েছি। ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে একটি টেকসই ও উঁচু বেড়িবাঁধ চেয়েছিলাম। উঁচু বাঁধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা টেকসই হয়নি। নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করায় বছর না যেতেই ভাঙন শুরু হয়েছে।

দ্রুত নদী শাসনের ব্যবস্থা করা না হলে দুই-তিন বছরের মধ্যেই বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যাবে।

শরণখোলা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আনোয়ার হোসেন পঞ্চায়েতে বলেন, “নদী শাসন ছাড়া টেকসই বাঁধ হওয়া সম্ভব নয়। তৎকালীন সরকার ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণে নদী শাসনের ব্যবস্থা না রেখে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এখানে। মাটির বদলে নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শুধু বাঁধ উঁচুই হয়েছে, কিন্তু টেকসই হয়নি। দ্রুত নদী শসন না করলে টই কোনোভাবে টিকবে না। বর্তমান সরকারের কাছে দুর্নীতি তদন্ত ও নদী শসন করে বাঁধ রক্ষার দাবি জানান এই বিএনপি নেতা।”

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “অধিক ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ১ হাজার মিটার এলাকার ভাঙনরোধে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে শরণখোলার বগী এলাকার প্রায় ৭শ’ মিটারে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ এবং সিসি ব্লক ও মোরেলগঞ্জ সীমানার ফাসিয়াতলা এলাকায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হবে।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন