খুলনায় গত ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনজনকে হত্যা এবং একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মোটিভ উদঘাটিত হলেও প্রকৃত সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েনি। হত্যাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সব সময়ে ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাড়িতে ঢুকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় নতুন করে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। নগরবাসী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ছেন।
পুলিশ ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১ আগস্ট রাতে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হয় সোনাডাঙ্গা থানাধীন সবুজবাগ এলাকার যুবক মনোয়ার হোসেন টগর। দুর্বৃত্তরা ওই রাতে টগরের বাড়ির দরজা নক করে সেখানে তার সাথে ৫ মিনিট ধরে কথোপকথনের একপর্যায়ে বুকে ছুরিকাঘাত তাকে হত্যা করে।
এ ঘটনায় বাড়ির আশপাশের সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামিদের শনাক্ত করতে পারলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় টগরের বাবা জামাল হাওলাদার ৭ জন আসামির নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ ও সবুজবাগ এলাকার স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, টগর স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী এবং মাদক কারবারির সাথে চলাফেরা করত। পরিবারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ থেকে দূরে থাকার জন্য তাকে বার বার বলা সত্তেও সে কোন কর্নপাত করেনি। ঘটনার দিন রাতে ৩ টি মোটর সাইকেলযোগে ৭ জন ব্যক্তি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা সকলেই টগরের পরিচিত।
সূত্রটি আরও জানায়, টগরের কাছে ওই সন্ত্র্রাসীরা পূর্বে কিছু টাকা পেত। সেই টাকা পরিশোধের জন্য সন্ত্রাসী একটি গ্রুপ তাকে প্রায় চাপ দিত। সেই টাকা পরিশোধ না করার কারণে তাকে সেই দিন রাতে সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।
সোনাডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম নিহত টগরের স্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেন, টগর পূর্বে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর ‘বি’ কোম্পানীর সদস্য ছিল। পরে সে পলাশ-কালা লাভলুর গ্রুপে যোগ দেয়। মাদক কারবারির টাকা নিয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তরা তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় তাদের অবস্থান শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে একই রাতের শেষ দিকে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে খুন হয় ভ্যান চালক আলামিন সিকদার।
ঘটনা প্রসঙ্গে থানার অফিসার ইনচার্জ এইচ এম শাহীন বলেন, স্ত্রী রিপা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী ছিল আলামিন সিকদার। প্রথম স্বামী আসাদুলে সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে আলামিন বিয়ে করে রিপা বেগমকে। আর এ জের হিসেবে ভোরে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় আলামিন সিকদারকে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই ফারুক সিকদার আসাদুলের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ২-৩ জনের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পুলিশ তদন্তে নেমেছে। হত্যাকান্ড ঘটিয়ে আসাদুল পালিয়ে যায়। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
অপরদিকে রোববার রাত পৌনে ৮ টার দিকে নগরীর ২ নং কাষ্টমঘাট এলাকার একটি সেলুনের সামনে অবস্থান নেওয়া যুবক সোহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে সন্ত্রাসীরা ৪ টি মোটরসাইকেল যোগে আসে সন্ত্রাসীরা। তাদের সকলের মাথায় হেলমেট এবং মুখে কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। সন্ত্রাসীর ছোড়া একটি গুলি সোহেলের পেটে বিদ্ধ হয়। স্থানীয়দের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরবর্তীতে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আবু তারেক বলেন, এ ঘটনায় থানায় এখনও পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের হয়নি। আমরা বিভিন্নস্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই বাচাই করে আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। রাতে শহরের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্নস্থনে টহল ডিউটি বাড়ানো হচ্ছে। স্পর্শকাতর স্থানে চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। আমাদের অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেএমপি পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার।
এদিকে একই রাতে মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় নগরীর মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার খানা বাড়ির সামনে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্রদিয়ে গলা কেটে হত্যা করে ঘের ব্যবসায়ী আলামিনকে। ঘটনার ১২ ঘন্টার বেশী সময় অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মীর আতাহার আলী বলেন, সোমবার সকালে নিহতের ভাই আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
তিনি জানান, ঘটনাস্থলে আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় খুনীদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয়দের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আলামিন ২০১৬ সালের পর থেকে মহেশ্বরপাশা এলাকা ছেড়ে দিয়ে বাদামতলার ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। সে মাঝমধ্যে ইজিবাইক চালত। গত কয়েকমাস আগে একটি মাছের ঘের লিজ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। রোববার রাতে মোটরসাইকেল চালিয়ে আলামিন মহেশ্বরপাশা দিঘীর পূর্বপাড় বাড়িতে যাচ্ছিল। ঘটনাস্থল অন্ধকার থাকায় সুযোগ বুঝে চলন্ত অবস্থায় গলাকেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। রাতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
এদিকে গত কয়েকমাস ধরে খুন, রাহাজানীসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব আ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার। তিনি বলেন, গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পর অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। লুট হওয়া অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। তাদেরকে গ্রেপ্তার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশ প্রশাসনের কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার তাদেরকে কাউন্সিলের মাধ্যমে মনোবল ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশের কার্যক্রম যেন দায়সারা। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড রুখতে পুলিশকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
কেএমপি সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, এসব হত্যাকান্ডগুলো টার্গেট কিলিং। যা পুলিশের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময়ে খুনীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু বিচার বিভাগের নমনীয়তার কারণে সহজে আদালতের মাধ্যমে কারাগার থেকে জামিন পেয়ে বের হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম চালায় তারা। বিচার বিভাগ কঠোর হলে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ রোধ করা সহজ হতো।
খুলনা গেজেট/হিমালয়/সাগর