দেশের ঐতিহ্য, স্থাপত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসে অনন্য পরিচিতি লাভ করা বাগেরহাট বিশ্বজুড়ে পরিচিত ‘মসজিদের শহর’ নামে। মধ্যযুগীয় অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ, দিঘি, সেতু ও স্থাপনা এই জেলার পরিচিতিকে আরও উজ্জ্বল করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৫শ শতকে তৎকালীন সুফি সাধক উলুগ খানজাহান আলী যে সুপরিকল্পিত নগর গড়ে তুলেছিলেন, তার স্থাপত্যই আজকের বাগেরহাটকে ‘মসজিদের শহর’ নামে বিশ্বমানচিত্রে স্থান পেয়েছে। খানজাহানের আমলে নির্মিত স্থাপনাগুলোর অধিকাংশই আজও দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর অমূল্য সাক্ষী হিসেবে। যার একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ। কিন্তু দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ ষাটগম্বুজ মসজিদ এখন ক্ষয়ের মুখে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, আর্দ্রতা এবং পরিবেশগত দূষণের প্রভাবে মসজিদের দেয়াল, মিহরাব, স্তম্ভ ও গম্বুজে ক্ষয় দেখা দিয়েছে। দ্রুত ক্ষয়ের কারণে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজ দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ ঝুঁকির সামনে। প্রাচীন চুন সুড়কি, পোড়ামাটির ইট এবং বেলে পাথরের সমন্বয়ে তৈরি ষাটগম্বুজ মসজিদটি বর্তমানে লবণাক্ততার সরাসরি আঘাতের শিকার। নিচের দিক থেকে উঠে আসা নোনা পানি শুকিয়ে ইটের ভিতরে লবণ ক্রিস্টাল তৈরি করছে, যা ধীরে ধীরে ইটের বন্ধন দুর্বল করে দিচ্ছে। এছাড়া দেয়ালজুড়ে সাদা লবণের স্তর, ফাটল, চুন খসে পড়া এবং মিহরাবের নকশার বিবর্ণতা এখন নিয়মিত দৃশ্য।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি এবং আইকমসের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, শিল্প এলাকার দূষণ, বর্ষায় আর্দ্রতা এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ততার কারণে ঐতিহ্যটির ক্ষয় বর্তমানে বহুগুণে বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঐতিহাসিক এই স্থাপনার ক্ষয়রোধে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোঃ শফিকুল আলমকে সভাপতি ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক রসায়নবিদ মোহাম্মদ আবুল হোসেনকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে।
ওই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মুহাম্মদ নাজমুল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ বদরুদ্দোজা মিয়া এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন। এই কমিটির সদস্যরা গত এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন শেষে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে মসজিদ পরিদর্শন ও সংগৃহীত নমুনার বিশ্লেষণ শেষে দেখা গেছে, বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদের মিহরাব যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোঃ শফিকুল আলম বলেন, “আমরা প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করেছি। সিডর ও আইলার সময় সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বায়ুতাড়িত লবণাক্ত পানির ছিটা মসজিদটির মিহরাবের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। সেই ক্ষত এখন আরও তীব্র হচ্ছে। এছাড়া দেয়ালের কয়েকটি অংশে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা দেখা গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “মসজিদটির মিহরাব ও স্তম্ভসমূহ বেলে পাথর দ্বারা নির্মিত। এই পাথর নরম ও ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় লবণ দ্বারা সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মিহরাবের নকশা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দুই পাশের স্তম্ভের ক্ষয়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। পাথর খ-গুলো ধরার জন্য ব্যবহৃত লোহার ক্ল্যাম্প ও ডাওয়েলগুলোতে মারাত্মক জং ধরে সংযোগ দুর্বল হয়ে গেছে। যার কারণে Load Bearing Capacity কমে গিয়ে যেকোনো সময় মিহরাব ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “মিহরাব ধসে পড়লে ষাটগম্বুজ মসজিদকে ইউনেস্কো ‘World Heritage in Danger’ ঘোষণা করতে পারে। এটি হলে, তা জাতীয় মর্যাদার জন্য বড় ধাক্কা হবে।” যে কারণে তদন্ত প্রতিবেদনে ইউনেস্কোর সহায়তায় ষাটগম্বুজ মসজিদে সংরক্ষণ ও সংস্কার কাজ দ্রুত শুরু করার সুপারিশ করা হয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে মূল কাঠামোও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, “ইউনেস্কোর সহায়তায় ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রতিটি দেয়াল, গম্বুজ ও স্তম্ভের ক্ষয়ানচিত্র তৈরি করা হবে, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা যায়। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে ঢাকা UNESCO অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে সাময়িক সংরক্ষণ কাজ শুরু করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে BUET এর অভিজ্ঞ স্ট্রাকচার ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তা নেওয়া হবে।” যেহেতু বাগেরহাটের প্রত্নস্থাপনাটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য, তাই পাথরের স্থাপনা সংরক্ষণে দেশে দক্ষ জনবল না থাকায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন লাভলী ইয়াসমিন।
তিনি আরও বলেন, “UNESCO এর সহায়তায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকদের নিয়ে একটি টিম গঠন করে টেকসই সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।”
এছাড়া সংরক্ষণ কাজের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় স্থপতি, প্রকৌশলী, রসায়নবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, “এতে ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য প্রত্নস্থাপনা সংরক্ষণে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারবেন।”
খুলনা গেজেট/এনএম

