সম্প্রতি আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশি বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলট রিয়ানা আজাদ (২৮) নামের এক নারী পর্যটক স্ব-পরিবারে ঘুরতে এসে রিসোর্টের জালি বোটে ফেরার পথে নদীতে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনদিন পর তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন প্রশাসন। এ ঘটনায় সুন্দরবনের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা রিসোর্ট ও বনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ ও সুন্দরবন ঘুরতে আসা পর্যটকরা মনে করছে বন ও বনসংলগ্ন এলাকায় চলাচলে পথে নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পর্যটক ব্যবসায়ীরা খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিয়াশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারি এলাকায় সুন্দরবনের অনুকূলে খালের পাড়ে সরকারি খাস (লিজ) নেয়া এবং মালিকানা জমিতে এই রিসোর্টগুলো তৈরি গড়ে উঠেছে। পর্যটক থাকার জন্য রিসোর্টগুলোতে মনোরম পরিবেশের ব্যবস্থা থাকলেও যাতায়াতের পথ অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন প্রতি বছর দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটককে আকর্ষণ করে। এই বনের অসাধারণ জীববৈচিত্র্য, বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং অনন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটনের এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণে এই অঞ্চলের পর্যটকদের নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন ভ্রমণকে আরও নিরাপদ ও উপভোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন পর্যটকরা।
পর্যটকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুন্দরবনে একাধিক ধরনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। নদ-নদী ও খালের কারণে জলপথে ভ্রমণই প্রধান মাধ্যম। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট না থাকা, পুরোনো বা ফিটনেসবিহীন নৌ-যান ব্যবহার এবং বৈরি আবহাওয়ায় ঢেউয়ের কারণে নৌকাডুবির ঝুঁকি থাকে।

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং আকস্মিক আবহাওয়ার পরিবর্তন সুন্দরবনে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা, যা পর্যটকদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। গত ৮ নভেম্বর ম্যানগ্রোভ ভ্যালি সুন্দরবন ইকো রিসোর্ট থেকে আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলট রিয়ানা আজাদ নামের এক পর্যটক স্ব-পরিবারে ওই রিসোর্টের জালি বোটে ফেরার পথে ঢাংমারি নামক স্থানে নদীর ঢেউয়ের কবলে পড়ে জালিবোট উল্টে নিখোঁজ হন। তিনদিন পর ১০ নভেম্বর তার ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। রিয়ানার মৃত্যুতে স্থানীয়ভাবে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটক ও সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তা জনিত ব্যাপার নিয়ে ব্যাপক সংশয় তৈরি হয়।
মেহেরিমা নামে এক নারী পর্যটক জানান, ওইদিন যদি তাদের গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকতো তাহলে ওই নারীকে নিখোঁজ হতে হতো না, এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না এবং আমার মনে হচ্ছে ডুবে যাওয়া বোটটি ফিটনেস বিহীন ছিল, বোটের তুলনায় যাত্রী বেশি নেওয়া হয়েছিল। এবং ওই বোটের মাঝির অভিজ্ঞতা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সুন্দরবন এ ঘুরতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রশাসনকে আরো কঠোর নজরদারি করার অনুরোধ করেন এই নারী পর্যটক।
পর্যটক বহনকারী মোংলা জালিবোট সমিতির নেতা সোহাগ জানান, পর্যটকদের জন্য নদীপথে লাইভ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। সম্প্রতি সময় জালিবোট উল্টে এক নারী পর্যটক নিহত হয়েছেন এটি অত্যান্তই কষ্টদায়ক ব্যাপার। তবে আমি মনে করি ওই জালিবোটে থাকা পর্যটকদের গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকলে এত বড় দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। লাইফ জ্যাকেট এর পাশাপাশি দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো বোট গুলিতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা। তাই আমি মনে করি পর্যটক ব্যবসায়ী সহ পর্যটকদের এ ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
মোংলা ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর নিমাই কুমার নাথ বলেন, ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয়ভাবে প্রত্যেকটা পয়েন্টে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তাদের সার্বিক সহযোগিতা করছি।

পূর্ব চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) দিপন চন্দ্র দাস জানান, ট্যুরিস্ট মৌসুম শুরুর পরপরই মোংলা ট্যুরস্ট ভোট মালিক সমিতির সাথে কয়েকবার মিটিং করা হয়েছে, সেখানে পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট এবং অতিরিক্ত পর্যটক বহনে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়াও খুলনাতে ট্যুর অপারেটর মালিকদের সাথে আমাদের বিভাগীয় প্রধানসহ ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তার জন্য সকল ধরনের দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পর্যটন এলাকায় নদীগুলোতে দ্রুতগতির স্পিড বোট বা জলযান যাতে ধীরে চালানো হয়, সে ব্যাপারে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি পর্যটক এবং নদী কূলের মানুষের সার্বিক দিক বিবেচনা করে খুব শীঘ্রই এর একটা সুরাহা হবে।পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য আমরা সব সময় প্রস্তুত রয়েছি। তবে রিসোর্টে এসে থাকা পর্যটকদের যাতায়াতের নিরাপত্তার জন্য রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন হতে হবে। আমরা চাই সুন্দরবন কেন্দ্রিক নিরাপদ সুন্দর একই পর্যটন ব্যবস্থা সকলের সহযোগিতায় গড়ে তুলতে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, যেকোনো সুযোগ-সুবিধা জন্য আমরা বনের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত রয়েছি। তবে নদীপথে যাতায়াতের সময় পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরিধান করা উচিত। অতিরিক্ত পর্যটক জালিবোট গুলির ছাদে না ওঠার জন্য আমরা নিরাপত্তাজনিত কাজ করে যাচ্ছি। সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আরো বেশি সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান এই কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/এনএম

