কুরআন এমন এক ঐশি মহাগ্রন্থ যা পড়লে প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ছওয়াব পাওয়া যায়। এর এক একটি লাইনও পরিপূর্ণ আমল হিসাবে গণ্য করা হয়। অন্যান্য আমলের ব্যাপার ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ; যোহরের ৪ রাকাত ফরজের জায়গায় ৩ রাকাত পড়লে পুরা নামাজটাই বাতিল হয়ে যায়। আবার নামাজ, হজ্জসহ অন্যান্য আমলের মধ্যে আবশ্যক বা ফরজ একটি অংশ বাদ গেলেও গোটা আমলটিই বাতিল বলে গণ্য হয়। কিন্তু কেউ যদি সূরা বাকারার প্রথম আয়াত ‘আলীফ-লাম-মীম’ এতটুকু পড়ে কুরআন বন্ধ করে তবুও কমপক্ষে ৩০ টি নেকী পাবে।
অথচ এই আয়াতের অর্থ দুনিয়ার কোন মানুষই জানে না। কুরআন না বুঝে পড়লেও ছওয়াব পাওয়া যায়, এটা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এ কথার অর্থ এটা নয় যে, তা বুঝে পড়ার দরকার নেই। বরং গভীরভাবে লক্ষ্য করলে পরিস্কার বোঝা যায় যে, কুরআন শুধু না বুঝে তেলওয়াত করার জন্য নাজিল হয়নি। গোটা কুরআন হলো জীবন পরিচালনার নির্দেশিকা; গাইড লাইন। আমরা যদি এর অর্থ না বুঝি তাহলে কীভাবে আমাদের জীবন কুরআনের আলোকে গঠন করব? এটা যেন সেই রোগীর মত যে ঔষধ সেবন না করে শুধু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন প্রতিদিন সকাল-সন্ধা দুইবার দেখে আর বলে যে, ডাক্তার যা বলেছে সব সঠিক। এরপর এটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দেয়।
কুরআনের একটি ছোট্ট ও বহুলপঠিত সূরা হলো, আর-আইতাল্লাজী..বা সূরা মাউন। মসজিদের বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামে আমি শতশত মানুষকে মাউন শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু ১/২ দুইজন ছাড়া কেহই এর অর্থ বলতে পারেনি। এটা মুসলমান হিসেবে আমাদের লজ্জার বিষয়। এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব ঘটনা মনে পড়ল। অনেকদিন আগের কথা। আমি একবার ক্লাসের এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি? সে বলল, মুতাফফিফীন। আমি বললাম, বেশ সুন্দর নাম তো, তা এর অর্থ কি? সে বলল, আমি এর প্রকৃত অর্থ জানিনে, তবে এই নামে কুরআনে একটি সূরা আছে। আমার আব্বু এই নামটি রেখেছেন। আমিও বললাম, ভেরি গুড! আমি আসলে না বুঝেই বলেছিলাম, ভেরি গুড। পরে যখন এই সূরাটির অর্থ আমি বাংলায় দেখলাম তখন তো আমার চোখ কপালে। কয়েকবার পড়লাম, আসতাগফিরুল্লাহ। আসলে মুত্বফফিফীন শব্দের বাংলা অর্থ যে ওজনে কম দেয় বা প্রতারণা করে।
মুতাফফিফীনরা ধ্বংস হোক, এই কথা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করে এরশাদ করেছেন, “যারা মাপে কম করে (মুতাফফিফীন), তাদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে। সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়, নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকবে (সূরা মুতাফফিফীন:১-৭)”। এখন তাহলে পাঠক বুঝতে পেরেছেন এই ‘মুতাফফিফীন’ নামটা কত মারাত্মক। অনেক ব্যবসায়ী মুসল্লী আছেন যারা এই সূরা নামাজে শুনছেন, আবার ঠিক একটু পরেই দোকানে গিয়ে মাপে কম দিচ্ছেন। আমার মনে হয় এই ব্যবসায়ী এই সূরার অর্থ জানেন না।
নামাজে ইমাম সাহেব সাধারণত কুরআনের শেষ দিকের ছোট ছোট সূরাগুলো পড়ে থাকেন। এগুলোর অর্থ কি আমরা সাধারণ মুসল্লী বুঝি? বুঝলে ভয়ে দীল কেঁপে উঠত; চোখে পানি চলে আসত। উদাহরণস্বরূপ, নামাযে বহুল পঠিত যিলযাল (ভূমিকম্প), তাকভীর (গুটিয়ে নিষ্প্রভ করে ফেলা), ইনফিতার (বিদীর্ণকরা), আল ক্বরিয়াহ (করাঘাতকারী মহাসংকট) প্রভৃতি সূরাতে কেয়ামতের যে ভয়াবহ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে কোনো মুমিনের অন্তর প্রকম্পিত না হয়ে পারে না।
সূরা মাউন (আরআইতাল্লাজি) জানেন না এমন মুসল্লি খুব কম আছেন। কিন্তু অর্থ জানেন কয় জন? এই একটি ছোট্ট সূরা মানুষের আখলাককে পরিবর্তন করতে পারে; পারে গরীব ও প্রতিবেশীর প্রতি তার মনোভাবকে পরিবর্তন করতে। মাউন শব্দের বাংলা অর্থ, সামান্য সহযোগিতা, যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিস প্রতিবেশীকে ধার দেওয়া। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কি বলেন দেখুন- “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।
অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজীর, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বে-খবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু (মাউন ) অন্যকে দেয় না (সূরা মাউন:১-৭)।” কি চিত্তাকর্ষক বাণী তাই না? এই সূরাতে এতিম ও গরিবদের সাহায্য করার পাশাপাশি নিত্য ব্যবহৃত ফেরতযোগ্য জিনিস, যেমন কাস্তে, কোদাল, বাসনপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনের সময় প্রতিবেশীকে ধার দেবার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আসলেই, আমরা যদি অর্থ জেনে কুরআন পড়তাম তাহলে তা আমাদের জীবনকে বদলিয়ে দিতে পারত। সংশোধন হতে পারত আমাদের খারাপ চরিত্র। নিজ ভাষায় কুরআন বুঝে পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে আরও কিছু লেখার অভিপ্রায় রইল।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/এনএম

