শুক্রবার । ৩রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩২

অমুসলিমদের অধিকার ও সহিংসতার পরিণাম

মাওলানা মোঃ ফজলুর রহমান

ইসলাম কোনো ধরনের সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করাকে সমর্থন করে না। পবিত্র কুরআন মজিদে এসব কর্মকা-কে আল্লাহ তায়ালা কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন। আল্লাহ পাক কুরআন মজিদের সুরা মায়েদায় উল্লেখ করেন- “যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন, লুটতরাজ, সম্পদ বিনষ্ট ইত্যাদির মাধ্যমে) ফেতনা-ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হলো, তাদের হয় হত্যা করা হবে, নয়তো শূলীতে চড়ানো হবে অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে কিংবা তাদের দেশান্তর করা হবে। এটা হলো তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে আরো কঠোর শাস্তি (আল-মায়েদা: আয়াত ৩৩)।”

উপরোল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সমাজে বিশৃঙ্খলা, ফেতনা-ফ্যাসাদ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। ইসলাম সংখ্যালঘু অমুসলিমদের অধিকার ও মর্যাদা এবং তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর হেফাজতের প্রতি জোর তাকিদ ও গুরুত্ব দিয়েছে। রাসুলে পাক (সাঃ) বলেন, “সাবধান! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো মু’আহিদ (তথা ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক)-কে অত্যাচার করবে অথবা তার কোনো হক নষ্ট করবে কিংবা তার সামর্থ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে অথবা মনের একান্ত ইচ্ছা ছাড়া তার কোনো সম্পদ নিয়ে নেবে, তাহলে জেনে রেখো, আমি তার বিরুদ্ধে কেয়ামতের দিন অভিযোগকারী হব। অর্থাৎ তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে নালিশ করব (আবু দাউদ শরিফ, ২/৪৩৩)।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়। (বুখারি, হাদিস : ২৯৯৫)।”

অন্য এক হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেন, “কোনো মু’আহিদ অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি জুলুম করা থেকে আমার রব আমাকে নিষেধ করেছেন (কানযুল উম্মাল, ২/২৭০)।” হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “সাবধান! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এমন মু’আহিদ তথা অমুসলিমকে হত্যা করবে, যাকে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (সাঃ) নিরাপত্তা দান করেছেন, তাহলে অবশ্যই সে আল্লাহ তায়ালার নিরাপত্তা বিধানের খেয়ানত করল। সুতরাং সে জান্নাতের ঘ্রাণও সে পাবে না। অথচ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকে জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায় (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ শরিফ)।” পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও অসংখ্য হাদিস থেকে কয়েকটি হাদিস ওপরে পেশ করা হলো। এর দ্বারা এ কথা সুস্পষ্ট বোঝা গেল, ইসলাম সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।

ইসলাম যেমন মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের জান-মালের হেফাজতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, তেমনি তাদের উপাসনালয়ের হেফাজতের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যাতে তারা নির্বিঘ্নে তাদের উপাসনালয়ে উপাসনা করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপন করতে পারে। তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া এবং উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না।

এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। এখানে তার কয়েকটি পেশ করা হলো- খলিফাতুল মুসলিমীন হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বায়তুল মাকদাসে খ্রিস্টানদের জান-মাল ও উপাসনালয় ইত্যাদির নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, তা পাঠকদের সামনে পেশ করা হলো-‘এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহ তায়ালার বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো।

এ চুক্তিনামা ইলয়াবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জান-মাল, গির্জা-ত্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা সব খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রয়োজন। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না এবং তাদের গির্জাকে ধ্বংস করা যাবে না ও কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদে কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না। ধর্মীয় যে-কোনো ব্যাপারে তাদের বাধ্য করা যাবে না। খ্রিস্টানদের কোনো ব্যক্তিকেই কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

চুক্তি অনুযায়ী ইলয়া তথা জেরুজালেম এলাকাটি শুধু খ্রিস্টানদের জন্য সংরক্ষিত, সেখানে কোনো ইহুদি বসবাস করতে পারবে না। এ চুক্তিনামায় যা কিছু লেখা হলো, তা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (সাঃ), খোলাফায়ে রাশেদিন এবং মুমিনদের পক্ষ থেকে চুক্তিনামা। তবে এ চুক্তিনামাটি ওই সময় কার্যকর হবে, যখন তারা তাদের ওপর আরোপিত জিযিয়া তথা নিরাপত্তা কর যথাযথ আদায় করবে।’

বিখ্যাত ফতোয়াগ্রন্থ ফতোয়ায়ে হক্কানিয়ায় সেই ঐতিহাসিক চুক্তিনামা বর্ণনার পর উল্লেখ আছে- উল্লিখিত চুক্তিনামায় অমুসলিমদের যে অধিকার ও স্বাধীনতার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা শুধু ইলয়াবাসী তথা জেরুজালেমের খ্রিস্টানদের সঙ্গে নির্দিষ্ট ছিল না, বরং সারা পৃথিবীতে যেখানেই মুসলমানরা বিজয়ীবেশে প্রবেশ করেছে, সেখানেই ওই এলাকার অমুসলিমদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। যেমন জুরজান নামের প্রসিদ্ধ শহর যখন মুসলমানদের আয়ত্তে চলে আসে, তখন সেখানকার অমুসলিমদের সঙ্গে যে অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষরিত হয়, তার ভাষা ছিল নিম্নরূপ-‘উক্ত এলাকার অমুসলিমদের জান-মাল, দ্বীন-ধর্ম সব কিছুর নিরাপত্তা দেওয়া হলো। উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা হবে না। আজারবাইজানের অমুসলিমদের সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল (সূত্র, ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া, ২/৪৮৫)।’ আল্লাহ তায়ালা সকলকে হেফাজত করুন, আমীন।

লেখক- প্রধান শিক্ষক, পশ্চিম বানিয়াখামার দারুল কুরআন বহুমুখী মাদ্রাসা, খুলনা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন