বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২

সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)

মাওলানা ফজলুর রহমান

মহানবী (সাঃ)-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ধনী, গরীব, ছোট বড়, মুসলিম-অমুসলিমের কোন ভেদাভেদ ছিল না। নীতির বেলায় তিনি তাঁর অনুসারী কিংবা বিরোধীদের মধ্যে কোনো বাছবিচার, পার্থক্য করেননি। একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে তাঁর একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রাঃ) সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দ-বিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবম-লী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্য যে তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হস্ত কর্তন করে দিতাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সোরাকা নামক জনৈক সাহাবি এক বেদুইনের কাছ থেকে উট ক্রয় করে তার মূল্য পরিশোধ না করায় বেদুইন তাকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে হাজির করল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে সোরাকা বলেন, ‘মূল্য পরিশোধ করার ক্ষমতা তাঁর নেই।’ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বেদুইনকে বলেন, ‘তুমি এটাকে বাজারে বিক্রয় করে তোমার পাওনা উসুল করে নাও।’ বেদুইন তা-ই করল। এভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি তাঁর পরিচালিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কতখানি যত্নবান ছিলেন, ওপরের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায়নিষ্ঠ বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য পূর্বশর্ত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইজতিহাদ করে বিচার করে এবং তাঁর ইজতিহাদ যদি সঠিক হয়, তাহলে তাঁর জন্য দু’টি পুরস্কার। আর ইজতিহাদে ভুল হলে একটি পুরস্কার। বিচারক তিন প্রকার। তন্মধ্যে দুই প্রকার জাহান্নামি ও এক প্রকার জান্নাতি। যে ব্যক্তি হক জেনে তার দ্বারা ফয়সালা করে সে জান্নাতি। যে ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত ফয়সালা করে, সে জাহান্নামি এবং যে ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে জুলুম করে, সেও জাহান্নামি।’ (ইবনে মাজাহ, পৃঃ ৩৪১-৩৪২)

সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বেশ কয়েকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। সমকালীন দুনিয়া, বিশেষত প্রাক ইসলামী সমাজে ধনসম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, কামিয়াবির নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ হন্যে হয়ে অর্থ ও সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে সারা জীবন। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারাম, ন্যায়-নীতি, পাপ-পুণ্য এসবের ধার ধারেনি। এভাবে মানুষ হয়েছে অর্থ-সম্পদের দাস আর অর্থসম্পদ হয়েছে তাদের প্রভু। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে ওহিনির্ভর যে দর্শন পেশ করেন তা হলো, মানবজীবনে অর্থসম্পদ অপরিহার্য। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অর্থসম্পদ অর্জন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কিš তা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। অর্থ, ধনসম্পদসহ দুনিয়ার সব কিছুই মানুষের সেবক ও খাদেম। পৃথিবীর সকল বস্তু নিশ্চয় মানুষের জন্য সৃষ্টি। (সুরা আল বাকারা : ২৯) সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জনগণকে নীতি ও বিধিসম্মতভাবে অর্থসম্পদ অর্জন করার এবং জাকাত ও সদকার মাধ্যমে সে অর্জিত সম্পদের কিয়দংশ দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন। অধিকš রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছয় ধরনের রাজস্ব প্রবর্তন করেন।

এগুলো হলো:
১. আল-গনিমাহ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ।
২. জাকাত।
৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকদের ভূমি কর।
৪. জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর।
৫. আল-ফাই বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি।
৬. সদকা বা স্বেচ্ছাধীন দান।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি থেকে তৈরি।’ (মুসনাদে আহমাদ: খঃ ২, পৃঃ ৩৩) এই পৃথিবীতে সব মানুষই যে আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান, কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-নির্ধন সবাই যে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ, সব মানুষই যে পরস্পর ভাই ভাই, ধর্মীয় ও কর্মীয় অধিকার যে সব মানুষেরই সমান এ কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবং স্বীয় কর্মে ও আচরণে প্রমাণ করেন ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এ কারণে ইসলামে সবার জন্য স্বীকৃত হয়েছে ন্যায়বিচারের অধিকার।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় ইনসাফপূর্ণ যে সমাজ কায়েম করেন, তার ভিত্তি ছিল নৈতিকতা ও মানবজাতির সার্বজনীনতা। মানুষ যদি রিপুর তাড়নার কাছে পরাভূত হয়, তাহলে সুস্থ সমাজের বিকাশধারায় সে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না। মনুষ্যত্বের উজ্জীবন, চারিত্রিক উৎকর্ষ ও নৈতিক উপলব্ধি সু¯ সমাজ বিকাশে সহায়ক আর ইন্দ্রিয়জাত প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অনিষ্টকর প্রথা সমাজের সু্স্থতার ভিত্তিমূলকে একেবারে নড়বড়ে করে দেয়। জন্ম হয় জুলুম ও বেইনসাফির। এই উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জুয়া খেলা, মদ্যপান, নেশা গ্রহণ, কুসিদ প্রথা, জিনা-সমকামিতা ও অহেতুক রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দেন। ফলে সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ভয়াবহতার হাত থেকে মানুষ রেহাই পায়।

উল্লেখ্য, মদ্যপান, জুয়াসহ যাবতীয় অমার্জিত, নীচু স্বভাবের অনিষ্ঠ কার্যকলাপ ও সব ধরনের আতিশয্য হলো খ্রিস্টান-ইহুদি ও পৌত্তলিক সমাজের অভিশাপ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, সভ্যতার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়ে ধর্মনিয়ন্ত্রিত ও মানবিকতায় উজ্জীবিত নতুন সমাজের গোড়াপত্তন। বিশ্বমানবতার প্রতি এটা মহানবী (সাঃ)-এর অসামান্য ইহসান। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তৎকালীন সমাজে প্রচলিত দাসপ্রথা উচ্ছেদে সাহসী ভূমিকা রাখেন। বিশ্বের ইতিহাসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-ই প্রথম, যিনি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তখনকার যুগে গোটা গ্রিস ও রোমান সা¤্রাজ্য দাসপ্রথার ওপর গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টজগৎ ও আরব সমাজেও ছিল দাসপ্রথার অবাধ প্রচলন। প্রভুরা নিজেদের মালিক-মনিব মনে করে দাসদের শ্রমকে শোষণ করত, তাদের দ্বারা অমানুষিক পরিশ্রম করাত।

মহানবী (সাঃ) শতাব্দীপ্রাচীন দাসপ্রথার অবসানকল্পে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং দাসমুক্তিকে সওয়াবের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর গৃহীত পদক্ষেপ দাসদের মানুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কারো করতলগত হওয়াটা তার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মানবসন্তান স্বভাবগত চাহিদা ও ইমানের দাবিতে ধর্মীয় কার্যকলাপ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে অপারগ। দাসত্বের শৃখল থেকে মুক্তিই তার জীবন, তার স্বাধীনতা তার শক্তি। এভাবে দাসরা মানবাধিকার ফিরে পেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ক্রীতদাস জায়েদ ইবনে হারেস (রাঃ)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হজরত আনাস (রাঃ), হজরত সালমান ফারসি ও সুহাইব রুমি (রাঃ) এবং অন্য ক্রীতদাসরা সামাজিক মর্যাদা লাভ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আনজাম দেন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বিশ্বনবী (সাঃ) এর আদর্শ মোতাবেক আমাদেরকে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, পশ্চিম বানিয়াখামার দারুল কুরআন বহুমুখী মাদ্রাসা খুলনা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন