গাজার আল-ওয়াফা মেডিকেল পুনর্বাসন হাসপাতালে দুই ফিলিস্তিনি ছেলে একে অপরের পাশে শুয়ে আছে। তারা দুই ভাই। একজন আট বছর বয়সী ইসমাইল আবু আল-জিবিন ইলিয়াস ও অপরজন পাঁচ বছর বয়সী আবু আল-জিবিন। তাদের মা আয়া আবু আউদা তাদের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলছিলেন।
কিন্তু কোনো শিশুই সাড়া দিচ্ছিল না। গাজা শহরের তেল আল-হাওয়া এলাকায় তাদের বাস্তুচ্যুত শিবিরে ইসরায়েলি বোমা হামলার সময় দুই ভাই আহত হয়। এখন তারা বধির, কানে শুনতে পায় না। গাজার ১০ জনের চারজনই এখন বধির।
আতফালুনা সোসাইটি ফর ডেফ চিলড্রেন পরিচালিত একটি মাঠ জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের যুদ্ধে এফ-১৬ বিমান এবং বিস্ফোরণের শব্দে ৩৫ হাজার শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্করা আংশিক বা স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।
মিডলইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হামলায় ইলিয়াস সম্পূর্ণ বধির হয়ে পড়ে এবং ইসমাইলের শ্রবণশক্তিও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে অস্থায়ী তাঁবুতে আউদা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে ঘুমাচ্ছিলেন, সেখানে পড়ে আছে আহত ইসমাইল। তার চোখ ও এক হাত ক্ষতিগ্রস্ত। শ্রবণশক্তির পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক সপ্তাহ পর তার মা লক্ষ্য করেন, কথা বললে ছেলেটি আর সাড়া দেয় না। কোনো কিছুই আর শুনতে পায় না।
ব্রেইনস্টেম অডিটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, তার ডান কানের শ্রবণশক্তি ৫০ শতাংশ এবং বাঁ কানের ৭১ শতাংশ হারিয়ে গেছে। ইলিয়াসের অবস্থা আরও গুরুতর। সে ১৮ দিন ধরে কোমায় ছিল। যখন সে জেগে ওঠে, তখন তার আর শ্রবণশক্তি নেই। গাজার ঘরে ঘরে এমনই অসুস্থতা নিয়ে দিন কাটছে বাসিন্দাদের।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিওলজি বিশেষজ্ঞ ইউসরা বাসিল নিশ্চিত জানান, এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের শব্দ ও বোমার বিস্ফোরণ বাসিন্দাদের শ্রবণশক্তির বড় ক্ষতি করেছে। গত দুই বছরের যুদ্ধে প্রতি ১০ জনের চারজনই এখন শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন।
আলজাজিরা জানায়, গাজা সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ৪৪ দিনে প্রায় ৫০০ বার গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল। এসব হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩৪২ জন। তাদের বেশির ভাগই শিশু, নারী এবং বৃদ্ধ। এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। সর্বশেষ শনিবার ২৭ বার হামলা হয়। এতে ২৪ জন শহীদ এবং ৮৭ জন আহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল বিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল বলেছেন, তাঁর সেনাবাহিনী হামাস ও হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়ে যাবে। তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
গাজায় গড়ে নিহত হচ্ছে দুই শিশু: ইউনিসেফ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও গাজায় গড়ে প্রতিদিন দুই শিশু নিহত হচ্ছে। শুক্রবার এ তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। সংস্থাটি বলছে, হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে চুক্তি হলেও গাজায় সহিংসতা থামেনি। জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্দো পাইরেস বলেন, ‘১১ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৭ শিশু নিহত এবং আরও কয়েক ডজন শিশু আহত হয়েছে।’
তিনি জানান, এর মানে হলো যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এবং হত্যাকাণ্ড থামানোর চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই শিশু নিহত হয়েছে। প্রতিটি সংখ্যার আড়ালে এমন একটি শিশু রয়েছে, যার জীবন সহিংসভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি পুনরাবৃত্তি করেন, এগুলো নিছক পরিসংখ্যান নয়।
ইউনিসেফ কর্মীরা গাজায় যা দেখছেন, তাঁর বর্ণনা দিয়ে পাইরেস বলেন, সেখানে অঙ্গহানি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে শিশুরা, অনেকে এতিম হয়ে গেছে এবং জলমগ্ন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ভয়ে কাঁপছে। আমি গত আগস্টে যখন সেখানে ছিলাম, তখন নিজেই এটি দেখেছি। তাদের জন্য কোনো নিরাপদ স্থান নেই এবং বিশ্ব তাদের এই দুর্ভোগ দেখে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। সম্প্রতি গাজায় ইউনিসেফ তাদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে। কিন্তু সেখানে কাজ করা কর্মীরা স্বীকার করেছেন, তাদের প্রচেষ্টা এখনও অপ্রতুল।
ইসরায়েলি হামলা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন : পাকিস্তান
ডন জানায়, গাজা উপত্যকাজুড়ে অব্যাহত ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর (এফও)। এই হামলাকে দেশটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান গাজাজুড়ে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং শান্তি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
হামাসের প্রতিনিধি দল কায়রোতে
গাজা যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে দেখা করতে হামাসের একটি প্রতিনিধি দল কায়রোতে অবস্থান করছে বলে মিসরীয় নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হামাসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিনিধি দলটি ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি চুক্তির অব্যাহত লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনা করবে। মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে। হামাসের প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন খলিল আল-হাইয়ার।
খুলনা গেজেট/এনএম

