বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২
আল জাজিরার বিশ্লেষণ

জেন-জি বিক্ষোভে উত্তপ্ত ভারতের লাদাখ, নেপথ্যে কী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

জেন-জিদের নেতৃত্বে সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হিমালয়ের কোলঘেঁষা লাদাখ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তরুণরা। পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন নিহত এবং ৭০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি ও বৃহত্তর সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে গত ছয় বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ ও অনশন কর্মসূচি পালন করছেন লাদাখের হাজার হাজার মানুষ। ২০১৯ সাল থেকে লাদাখে কেন্দ্রশাসন জারি করে ভারত সরকার।

তবে বুধবার, তরুণদের একটি দল এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে সরে আসে। অনশন কর্মসূচির নেতৃত্বদানকারী সোনম ওয়াংচুক বলেন, এটি তরুণদের এক ধরণের বিস্ফোরণ, জেন-জিদের বিপ্লব।

বুধবার ভিডিও বার্তায় ওয়াংচুক এই মাসের শুরুতে নেপালসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে সাম্প্রতিক বিদ্রোহের কথাও উল্লেখ করেন।

লাদাখে যে কারণ বিক্ষোভ
বুধবার সকালে সামাজিক-ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত লাদাখ অ্যাপেক্স বডির নেতৃত্বে স্থানীয় লাদাখি কর্মীদের অনশন ১৫তম দিনে প্রবেশ করে।

দুই সপ্তাহ ধরে অনশন চালিয়ে যাওয়ার পর আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৬২ এবং ৭১ বছর বয়সী দুই কর্মীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ক্ষব্ধ হয়ে লাদাখে ধর্মঘটের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভকারীরা তাদের সাথে আলোচনা বিলম্বিত করার জন্য মোদি সরকারের ওপরও ক্ষুব্ধ ছিলেন।

ওয়াংচুক বলেন, এই বিষয়গুলো তরুণদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কাজ করছে না।

এরপর তুরণদের নেতৃত্বাধীন দলগুলো লেহের শহীদ স্মৃতি উদ্যানে বিক্ষোভস্থল থেকে স্থানীয় সরকারি ভবন এবং একটি বিজেপি অফিসের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়। এরপর পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। এতে চারজন নিহত হয়।

অনশন ধর্মঘটের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের সমন্বয়কারী জিগমত পালজোর বলেন, এটি লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। তারা আমাদের তরুণদের হত্যা করেছে।

পালজোর আল জাজিরাকে বলেন, পাঁচ বছর ধরে সরকারের দেয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে জনগণ ক্লান্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।

তিনি জানান, তার সংগঠন শান্তির আহ্বান জানিয়ে অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

এক বিবৃতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক জনগণকে উসকে দিয়েছেন এবং নেপালের ‘জেন-জি’ আন্দোলন ও আরব বসন্তের উদাহরণ টেনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন।

বিক্ষোভকারীরা কী চান
২০১৯ সালে মোদি সরকার একতরফাভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। রাজ্যটিতে তিনটি অঞ্চল ছিল: মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর উপত্যকা, হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং লাদাখ, যেখানে মুসলিম এবং বৌদ্ধ উভয়ই জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।

এরপর মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করে। জম্মু ও কাশ্মীরের একটি আইনসভা রয়েছে, লাদাখের একটিও নেই। যদিও উভয় রাজ্যই কেন্দ্রশাসিত এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো ক্ষমতা তাদের নেই। জম্মু ও কাশ্মীরের আইনসভা অন্তত তার জনগণকে স্থানীয় নেতাদের নির্বাচন করার অনুমতি দেয়। তবে লাদাখে এই সুবিধাও নেই।

বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর থেকে, লাদাখের স্থানীয় লোকজন নিজেদেরকে আবিষ্কার করে আমলাতান্ত্রিক শাসনের অধীনে। এই অঞ্চলের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি তফসিলি উপজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত। এই মর্যাদার কারণে লাদাখকে ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। এটা করা হলে এই অঞ্চলগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক ও শাসন কাঠামো পাবে। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বর্তমানে ১০টি অঞ্চল তফসিলের আওতায় তালিকাভুক্ত রয়েছে।

তবে মোদি সরকার রাজ্যের মর্যাদা এবং লাদাখের ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষার বিরোধীতা করে আসছে।

জম্মু ও কাশ্মীরকে লাদাখ থেকে পৃথক করার ফলে লাদাখিদের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরে কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বাসিন্দারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি খাতে নিয়োগের জন্য স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন না করার অভিযোগও করেছেন।

ওয়াংচুক বলেন, তরুণ বিক্ষোভকারীরা পাঁচ বছর ধরে বেকার, আর লাদাখকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে না। সামাজিক অস্থিরতার এটাই কারণ: তরুণদের বেকার রাখা এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া।

লাদাখের সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ, যা ভারতের জাতীয় গড়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে যে, লাদাখের স্নাতকদের মধ্যে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেকার, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।

লেহের শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, লাদাখে যা ঘটছে তা ভয়াবহ। লাদাখকে এই প্রান্তে ঠেলে দেয়াটা আতঙ্কের।

তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছরে, লাদাখিরা তাদের পরিচয়ের বিপদ বুঝতে পেরেছে। ২০১৯ সালে তাদের মর্যাদা ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে মানুষ অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার প্রতি অনড়।

ওয়াহিদ বলেন, তরুণদের ক্ষোভ বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ তারা অধৈর্য। তারা বছরের পর বছর ধরে একটি সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন তারা হতাশ কারণ তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

লাদাখে কি আগে কখনও বিক্ষোভ হয়েছে:
অঞ্চলটির আধা-স্বায়ত্তশাসন এবং রাজ্যের মর্যাদা বাতিলের পর থেকে, বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাগরিক গোষ্ঠী প্রতিবাদ মিছিল করেছে এবং মাঝে মাঝে অনশন ধর্মঘট করেছে।

শিক্ষক ওয়াংচুক, লাদাখের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে গত তিন বছরে পাঁচটি অনশন ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি লাদাখের বিক্ষোভের সবচেয়ে সুপরিচিত মুখ। তিনি তার টেকসই উদ্ভাবনের কারণে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ওয়াংচুকের জীবন একটি বলিউডে একটি সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত লাদাখ রাজ্যে কাশ্মীরিদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সালের আগস্টে বিক্ষোভ হয়। এ সময় গুলিবর্ষণ তিনজন মারা যায়।

তবে বুধবারের বিক্ষোভ লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন হিসেবে চিহ্নিত।

আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার জন্য মোদি সরকার গঠিত কমিটির একজন বেসামরিক সদস্য সাজাদ কারগিলি বলেছেন, লাদাখে সহিংসতা ‘আমাদের তরুণদের হতাশাকেই তুলে ধরে’।

লাদাখ কেনো এতো গুরুত্বপূর্ণ:
লাদাখ ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত চীনের সীমান্তবর্তী এলাকা। এই অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমালা, বিমানঘাঁটি এবং পরিবহন রুটের সঙ্গেও সংযুক্ত। চীন সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালে, চীনা অনুপ্রবেশের পর পূর্ব লাদাখে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

সংঘর্ষে চীনের চারজন এবং ভারতের ২০ জন সেনা নিহত হন। সংঘর্ষের ফলে সীমান্ত জড়ো হয় উভয় পক্ষের কয়েক হাজার সেনা। সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয় ভারী অস্ত্রশস্ত্র।

তারপর থেকে, লাদাখ ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কয়েকদফা সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনার ফলে গত বছরের শেষের দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াহিদ বলেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরকে ‘অসন্তোষের কেন্দ্র’ হিসেবে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এখন তাদের লাদাখকেও মোকাবেলা করতে হবে।

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন