সোমবার । ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২

বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুল দরকার!

আবদুল কাদের খান

সর্বত্র অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। বাসা বেঁধেছে বলি কেন, বলা যায়, সর্বত্র অনিয়মের একচেটিয়া রাজত্ব চলছেই তো চলছে। সেদিন অলস দুপুরে শুয়ে ‘খুলনা গেজেট’ এর উপর চোখ বুলাচ্ছিলাম, প্রথম পাতায় প্রকাশিত দুই কলামের খবরটি বেশ আতঙ্কের ও আশঙ্কার!

শিরোনাম ছিল : “কেডিএ কেসিসি’র নির্দেশনা উপেক্ষিত, এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ/সরকারি রাস্তা দখল করে সীমানা প্রাচীর ও বাড়ি নির্মাণ”- খবরটি সামান্য মনে হলেও এর উচ্চমাত্রার গুরুত্ব রয়েছে। একজন হঠাৎ বড়লোক ব্যক্তি কাউকে পরোয়া না করেই এসব কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছেন। খবরটির পুরো কাহিনী পড়লে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে। কেডিএ অর্থাৎ খুলনা ডেভলপমেন্ট অথরিটি বাংলায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- তার চোখে সহজেই ধুলি দেয়া হয়েছে। গল্পের এখানেই শেষ নয়, আরো আছে। কেসিসি অর্থাৎ খুলনা সিটি কর্পোরেশনের স্পষ্ট নির্দেশনা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভদ্রলোক এতই চতুর ও কুৎসিত সুকৌশলী যে, কোনো কিছুরই তিনি তোয়াক্কা করেন না।

কেডিএ-কেসিসি’র নির্দেশনা উপেক্ষা করে দেশ, প্রশাসনের নাকের ডগায় সরকারি রাস্তার জমি দখল করে তিনি সীমানা প্রাচীর ও আস্ত একখানা বাড়ি নির্মাণ করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা ঠিক এমন যেন, ওই লোকের বেআইনি এই কর্মকা- চালানোর সময়, সবাই দারুণভাবে ঘুমে অজ্ঞান ছিল। এই ফাঁকে লোকটি এসব নির্মাণ কাজ করে ফেলেছেন! খোদ খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা কেডিএ এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশন অর্থাৎ কেসিসি’র চেয়ে তার হাত যে লম্বা, সে যে দারুন প্রভাবশালী, এতে কোন সন্দেহ নেই। একজন নাগরিকের অত্যন্ত দুঃসাহস ও স্পর্ধার খবরও বটে!

খুলনা মহানগরের হৃদপিন্ডের উপর মিস্ত্রিপাড়া খালপাড় সড়কে এ ঘটনাটি ঘটেছে। খবরে বলা হয়েছে, মহানগরী খুলনার মিস্ত্রিপাড়ায় শহীদ জিয়া সড়কের প্রবেশ মুখে সরকারি রাস্তার জমি দখল করে নির্বিবাদে সীমানা প্রাচীর সহ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ওই এলাকার জনৈক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এই বেআইনি দুঃসাহসিক কাজটি করেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ঘটনাটি জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেওয়ায় এলাকাবাসী এই অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ পেশ করেছেন। পজিটিভ ফল যে পাওয়া যায়নি তা নয়, এলাকাবাসীর চাপের মুখে সিদ্দিক তার নির্মাণ করা সরকারি জমির উপরের প্রাচীর ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সিদ্দিকের প্যাচাল ও কুকীর্তি এখনো শেষ হয়নি। কি সেই কুকীর্তি সে প্রসঙ্গে আসছি —

অপরাধ বিজ্ঞান বলে, “অপরাধী অপরাধ সংঘটনের পর মহা আনন্দে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, গৌরব করে মনে মনে বলে, “আমার কর্মকাণ্ড রুখবে কে? এবং অপরাধী তার অপরাধ কর্মের শেষ চিহ্নটুকু রেখে দেয়। মিস্ত্রি পাড়ায় খাল পাড়ে শহীদ জিয়া সড়ক সংলগ্ন এলাকার মোহাম্মদ সিদ্দিক মিয়া অবশেষে নতি স্বীকার করে তার স্বেচ্ছাচারী হাতে তৈরি বেআইনি সীমানা প্রাচীর ভাঙলেও প্রাচীরের পিলারগুলো এখনও ভাঙেননি। তাহলে টোটালি কি দাঁড়ালো? প্রশাসনের নির্দেশকে সে নিঃসন্দেহে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করেছে। খুলনার কে ডি এ এবং কেসিসি প্রশাসনকে সে থোড়াই কেয়ার করে বলে আমাদের মনে হয়েছে। প্রশাসন যদি সিদ্দিকের কোনো দেন-দরবারের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দুর্বল কিংবা জিম্মি না হয়ে থাকে, তাহলে উচিত হবে, ওই সিদ্দিককে নির্দেশ অমান্য করার দায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দু’টিরই ব্যবস্থা করা। কারণ এ ধরনের বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুল দরকার! দরকার অবিলম্বে বুলডোজার দিয়ে ওই বেআইনি সীমানা প্রাচীরের পিলার মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এলাকার আরো ১০ জন এই ঘটনা দেখে আইন অমান্য করার শাস্তি বা পরিণাম কী সহজেই বুঝতে পারবে। এ ব্যাপারে যদি ‘বজ্র আটুনি ফস্কা গেরোর’ মাধ্যমে ‘ইঁদুর বিড়াল’ খেলা হয়, তবে তা হবে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের একটি নগ্ন দৃষ্টান্ত। কথাগুলো কর্তৃপক্ষীয়দের মনে রাখতে হবে।

সর্বশেষ জানা গেছে, সরকারি রাস্তা দখল করে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করার দায়ে কেডিএ কর্তৃপক্ষ জমি মালিক ওই সিদ্দিককে একটি কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছেন। সিদ্দিকের এই অনিয়ম কার্যক্রমের গল্প বড়ই বিস্ময়কর ! শহীদ জিয়া সড়কের প্রবেশ মুখে মিস্ত্রিপাড়া খালপাড় সড়কের মোহাম্মদ সুন্দর আলীর ছেলে এই সিদ্দিক ৮ ফুট সরকারি রাস্তার তিন ফুট দখল করে নিজস্ব প্রভাবে বাড়ি ও সীমানা প্রাচীন নির্মাণ করায় সরকারি রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায়, প্রবল আপত্তি তোলে এলাকাবাসী। সিদ্দিক কারো কথা তোয়াক্কা না করে এই বেআইনি কাজ নির্বিঘ্নে সমাধা করেন। এলাকাবাসীও বসে থাকেনি, তারা এই দুষ্কর্মের সুরাহার পথ খুঁজে চলেছে। পরে এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে ২২’শে অক্টোবর ২০২৫ সিটি কর্পোরেশনের স্টেট অফিসার গাজী সালাহউদ্দিন ও সার্ভেয়ার খাইরুল সরেজমিনে পরিদর্শন করে ৭ দিনের মধ্যে সীমানা প্রাচীর ভেঙে রাস্তা অবমুক্ত করতে বললেও সিদ্দিক তার তোয়াক্কা করছে না। বরং বিভিন্ন স্থানে দেন-দরবার ও তদবির শুরু করেছেন। জনদুর্ভোগ নিরসনের জন্য ইতোমধ্যে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার সহ ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে অনুরোধ করার পর ২৫ অক্টোবর গভীর রাতে লোক চক্ষুর অগোচরে বেআইনি দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেললেও প্রাচীরের পিলারগুলো অক্ষত রাখায় এলাকাবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

কেসিসি’র দেয়া রেকর্ড অমান্য করে সিদ্দিক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ৮ ফুট রাস্তা বিশ ফুট দেখিয়ে প্ল্যান তৈরি করে এ দুর্ভোগের জন্ম দিয়েছেন। আমাদের বক্তব্য, কেডিএ কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়া কীভাবে এই প্লান পাস করলো, যা বাস্তবের সাথে কোনভাবেই মিল খায় না। ইতোমধ্যে পানি বেশ গড়িয়েছে। কেডিএ চেয়ারম্যান অভিযোগ পেয়েই কেডি-এর অথরাইজড অফিসার দিয়ে সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।

এস্টেট অফিসার গাজী সালাহউদ্দিন বলেছেন, “ভবনের সামনে ১০.৮২ ফুট জমি উন্মুক্ত রাখার বিধান থাকলেও ওই সিদ্দিক রেখেছে মাত্র দুই ফুট জমি। ওই ভবনের ডাইন, বাম, পেছনে মাত্র ১.৬ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে, যেখানে রাখার কথা ৩.৩ ফুট জমি। গোটা ব্যাপারটাই স্বেচ্ছাচারিতা।”

এমতাবস্থায় স্টেট অফিসার গাজী সালাহউদ্দিন বলেছেন, “রাস্তা দখল করে কেউ এক চুল পরিমাণ জায়গাও রাখতে পারবে না। সিদ্দিক যদি স্বেচ্ছায় ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আমরা অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেব।” সিদ্দিক দাবি করেছে, “আমি কোনো জায়গা দখল করিনি, দলিলে যা উল্লেখ ছিল তা থেকে আমি দুই ফুট ছেড়ে দিয়েছি। পরিস্থিতি জটিল হতে হতে এখন ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়েছে। যেমন, একদিকে কেডিএ কেসিসি অন্যদিকে সিদ্দিক। এ ধরনের রশি টানাটানির মুখে কেডিএ’র স্টেট অফিসার মৌখিকভাবে বলেছেন, “অবাধ্যতা কিংবা আইন অমান্য বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়োজনে সীমানা প্রাচীরের পিলারগুলো কেটে ফেলা হবে।” এটাই তো বাপের বেটার মত কথা!

আমরা দেখতে চাই, ‘সর্ষের ভিতর যদি ভূত’ না থাকে, তাহলে খুলনা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ অনিয়মের সুরাহা কেডিএ কেসিসি কর্তৃপক্ষ বিলম্বে হলেও করবেন। অন্যথায়, ঈশান কোণে যে সর্বনাশা মেঘ দেখা দিয়েছে, তা প্রবল কালবৈশাখীর দাপট দেখালে, থলের বিড়াল লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে! আশা করব কেডিএ কেসিসি কর্তৃপক্ষ সময় থাকতে শক্ত হাতে বিষয়টি সুরাহা করবেন।’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন