বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এখন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। রাস্তায় আগুন নেই, মিছিলে জনসমুদ্রও নেই, কিন্তু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অস্থিরতার গন্ধ। সবাই বুঝতে পারছে, কোনো অদৃশ্য প্রস্তুতি চলছে—একটি বড় কিছুর আগে যেমন প্রকৃতি হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, দেশের রাজনীতিও ঠিক তেমনই নীরব হয়ে আছে। এই নীরবতার ভেতরেই ঘনীভূত হচ্ছে এক `ছায়াযুদ্ধ’—যার লক্ষ্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকার বলছে, নির্বাচন বানচালে কাজ করছে `বড় শক্তি’—ভেতর থেকেও, বাইরে থেকেও। সাইবার হামলা থেকে শুরু করে তথ্য বিকৃতি—সব দিক থেকেই সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর ভাষায়, “এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড়ই আসুক, আমাদের তা অতিক্রম করতে হবে।”
রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হলেও শেখ হাসিনা নিশ্চুপ নন। লন্ডন ও ওয়াশিংটনে পিআর এজেন্সি এবং শীর্ষ ল’ ফার্ম নিয়োগ দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নতুন এক ফ্রন্ট—তথ্যযুদ্ধের ফ্রন্ট। রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে; সময়, ভাষা আর টোন—সব কিছুতেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ। এটি নিছক রাজনৈতিক প্রচার নয়; এটি এক ধরনের প্রত্যাবর্তন—শব্দের ভেতর দিয়ে ক্ষমতার পরিসরে ফিরে আসা।
আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, শেখ হাসিনার এই প্রচারণা `প্রতিরক্ষামূলক কূটনীতি’—অন্যদিকে ইউনূস সরকারের ঘনিষ্ঠজনেরা একে দেখছেন নির্বাচনের বৈধতা নষ্টের পরিকল্পনা হিসেবে। বাস্তবতা হলো—দেশ এখন এক অদ্ভুত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাষ্ট্র ও বিরোধী রাজনীতি—দুটোই সক্রিয়, কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত মঞ্চে।
এই সময়ের রাজনীতি আর শুধু মাঠের নয়; যুদ্ধ এখন স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, নিউজ সার্ভারে।
ভুয়া ভিডিও, বিকৃত প্রতিবেদন, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে মিথ্যা বিশ্লেষণ—সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ভয়ংকর ডিজিটাল বিভ্রম। সরকার আশঙ্কা করছে, নভেম্বর থেকেই শুরু হবে পরিকল্পিত সাইবার হামলা, যার লক্ষ্য নির্বাচনী কাঠামো ও জনমত। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের নির্দেশ স্পষ্ট—“প্রযুক্তিগত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলো, তথ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখো।”
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তথ্যযুদ্ধে জিততে কি শুধু প্রযুক্তিই যথেষ্ট? জনগণের বিশ্বাস কি ফায়ারওয়াল দিয়ে রক্ষা করা যায়?
পাশের দেশ ভারত বারবার বলছে, “বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন চাই।” শব্দটি শীতল, কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে চাপের উষ্ণতা। দিল্লি চায় না, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হোক—তবে নির্বাচন যদি একপাক্ষিক হয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে কষ্ট হবে, সেটিও তারা জানে। ফলে ভারত এখন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করছে—সরকারের পাশে থেকেও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের বার্তা দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউনূস সরকারের জন্য কাজটা সহজ নয়। একদিকে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি—নির্বাচন কমিশন, নিরাপত্তা, প্রশাসন; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, তথ্যপ্রবাহ ও আস্থার রাজনীতি।
সরকারের দাবি, ষড়যন্ত্র হচ্ছে; সমালোচক বলছেন, এটি সরকারের ভয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মত একটাই—ষড়যন্ত্র থাক বা না থাক, অস্থিরতার সম্ভাবনা বাস্তব। কারণ তথ্যপ্রবাহ এখন সীমান্ত মানে না। লন্ডনে তৈরি এক গুজব মুহূর্তেই ঢাকায় মিছিলে পরিণত হতে পারে। এই তথ্যনির্ভর যুগে নির্বাচনের ওপর আঘাত মানে কেবল ব্যালট নয়—রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপরও আঘাত।
সবশেষে, এই ছায়াযুদ্ধের চূড়ান্ত বিচারক জনগণই। যদি মানুষ বিশ্বাস করে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তবে কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। কিন্তু যদি আস্থা হারায়, তবে শত প্রস্তুতিও অর্থহীন হয়ে পড়বে।
সরকারের সামনে তাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ—বিশ্বাস পুনর্গঠন।
এই নির্বাচন কেবল সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নয়; এটি এক রাজনৈতিক পুনর্জন্মের সুযোগ।
স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও ন্যায্যতা যদি নিশ্চিত হয়, তবে এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নতুন আশার আলো জ্বালবে। আর যদি বিভ্রান্তি, বিলম্ব বা প্রভাবশক্তির টানাপোড়েন জারি থাকে, তবে আগামী দিনের রাজনীতি আরও অনিশ্চয়তার পথে যাবে।
এছাড়াও বুধবার রাতে ভার্চুয়ালি যুক্তরাজ্য থেকে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটি মনে করে, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। বিএনপি এই পদক্ষেপকে আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার অপচেষ্টা হিসেবে দেখছে এবং বলছে, কমিশন, সরকার ও কিছু রাজনৈতিক দল একই পক্ষ হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি নির্বাচনই কঠিন ছিল, কিন্তু এবারকার নির্বাচন অভূতপূর্ব। এবার প্রতিপক্ষ দৃশ্যমান নয়, যুদ্ধও রাস্তায় নয়—যুদ্ধ এখন তথ্যের, প্রভাবের ও বিশ্বাসের। সরকার যদি সত্যিই বিশ্বাস করে ষড়যন্ত্র চলছে, তবে প্রস্তুতি হতে হবে শুধু প্রশাসনিক নয়—প্রযুক্তিগত, কূটনৈতিক ও মানবিক স্তরেও।
কারণ, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন জিতবে না কোনো দল— জিতবে সেই পক্ষ, যে জনগণের আস্থা জিততে পারবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email: niazjournalist@gmail.com
খুলনা গেজেট/এনএম

