সোমবার । ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২

ছেলে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি

আয়শা আক্তার জ্যোতি

আমাদের সমাজে ছেলে সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা বহুদিনের। আজও অনেক পরিবার মনে করে-ছেলে হলে বংশ রক্ষা হবে, সম্পত্তি নিরাপদ থাকবে, শেষ বয়সে ভরসা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে মেয়ে হলে তাকে বড় করতে হবে, বিয়ে দিতে হবে, আর্থিক ব্যয়ও বাড়বে। এই ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ২০২৫ সালে এসেও অর্থাৎ আজকের দিনেও সমাজে প্রথিত। এর ভয়াবহ রূপই দেখা যায় সম্প্রতি খুলনা নগরীতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনায়। যেখানে নগরীর রূপসা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রামপালের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ফকিরহাটের মেয়ে শাহাজাদীর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। তাদের ঘরে আগে চার কন্যা সন্তান আছে। এবার ছেলে হবে- এমন প্রত্যাশা ছিল স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের। ছেলে না হওয়ায় স্ত্রীকে হাসপাতালেই ফেলে চলে যান স্বামী। এরপর আর খবর নেননি। পরিবারের চাপ ও হতাশার মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ঘটে অঘটন। একই হাসপাতাল থেকে আরেক প্রসূতির চার দিন বয়সি ছেলে নবজাতক চুরি হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও পুলিশের তৎপরতায় উদ্ধারও করা হয়। শাহাজাদীর মা নার্গিস বেগমের কাছ থেকে চুরি হওয়া নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। তখন আটক হন তিনি।

শিশু চুরির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো পড়ে একাধিক প্রশ্ন জেগে উঠে- কেন চুরি করলো, কারা বাধ্য করলো, এখনো কেন মেয়ে সন্তানকে নিচু নজরে দেখা হয়, তাহলে কি মেয়ে সন্তান পরিবার ও সমাজের বোঝা?

একজন মা নিজের সন্তানকে ফেলে অন্যের সন্তান নিতে চাইবে- না এটা স্বাভাবিক নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে অনেকদিনের সামাজিক চাপ ও মানসিক নির্যাতন। পরিবারের ভেতরে ক্রমাগত বলা হয়- ছেলে ছাড়া সংসার অসম্পূরক। শ্বশুরবাড়ি ও আত্মীয়দের ঠাট্টা-বিদ্রুপ তাকে ভেঙে দেয়। স্বামী যদি সহায়ক না হয়ে চাপ সৃষ্টি করেন, তবে মায়ের মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এই চাপ যখন অসহনীয় হয়, তখন অনেক মা ভুল পথে হাঁটতে বাধ্য হন। চুরির মতো অপরাধ তখন হয়ে ওঠে তাদের কাছে সমস্যার সমাধান।

কারা বাধ্য করলো?
সন্তান জন্মের পর মা যেমন আনন্দ পান, তেমনি অনেক সময় ভীষণ অসহায়ও হয়ে পড়েন। বিশেষ করে মেয়ে জন্মালে।
পারিবারিক চাপ: শ্বশুরবাড়ির কথায় মেয়ে সন্তানকে ‘বোঝা’ বলা হয়।
স্বামীর উদাসীনতা : অনেক সময় স্বামী তার স্ত্রীকে দোষারোপ করেন- ছেলে না হওয়ার জন্য। সামাজিক চাপ : প্রতিবেশী বা আত্মীয়রা মেয়ে জন্মকে কটাক্ষ করে। এভাবে মাকে বারবার বোঝানো হয়, ছেলে ছাড়া তার মর্যাদা নেই। এভাবেই তিনি অজান্তে অপরাধের পথে ধাবিত হন।

এখনো কেন মেয়ে সন্তানকে নিচু নজরে দেখা হয়? বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে এর কারণ বহুমাত্রিক-

বংশ রক্ষার ভ্রান্ত ধারণা : মনে করা হয়, বংশ কেবল ছেলের দ্বারা টিকে থাকে।

অর্থনৈতিক চিন্তা : বিয়ে দিতে গিয়ে কন্যার পরিবারকে যৌতুক ও উপঢৌকন নামের বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে হয়।
নারীর কর্মসংস্থান সীমিত ভাবা : মেয়েরা সংসারের বাইরে বড় কিছু করতে পারবে না- এমন ধারণা এখনো অনেকে পোষণ করেন।
কুসংস্কার : অনেক পরিবার মনে করে ছেলে হলে ঘরে সৌভাগ্য আসে, মেয়ে হলে দুর্ভাগ্য নেমে আসে। ফলে জন্মের মুহূর্ত থেকেই কন্যাশিশু অবহেলার শিকার হয়।

তাহলে কি মেয়ে সন্তান পরিবার বা সমাজের বোঝা?
একেবারেই নয়, বরং বাস্তবতা বলছে- আজকের বাংলাদেশে মেয়েরাই বড় সম্পদ। শিক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। একাডেমিক শিক্ষায় অনেক অঞ্চলে মেয়েদের ফলাফল ছেলেদের চেয়ে ভালো। চিকিৎসা, প্রকৌশল, প্রশাসন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারীরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন।

তাহলে কেন মেয়ে সন্তানকে বোঝা ভাবা হবে?
বাস্তবতা হলো, ছেলে বা মেয়ে নয়- সন্তান মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি- নবজাতক চুরির মতো ঘটনা কেবল অপরাধ নয় বরং সমাজের পশ্চাৎপদ মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। এই মানসিকতা বদলানো না গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। পরিবারকে বুঝতে হবে, মেয়ে সন্তান বোঝা নয়। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে সন্তান জন্মের সময় ছেলে-মেয়ের পার্থক্য না করে আনন্দ করা যায়। গণমাধ্যম ও সমাজকর্মীদের আরও জোরালো প্রচারণা চালাতে হবে। ছেলে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা থেকে নবজাতক চুরির মতো ঘটনা আসলে আমাদেরই তৈরি করা কুসংস্কার ও বৈষম্যের ফল। একদিকে আমরা নারীশক্তির ক্ষমতায়ন নিয়ে গর্ব করি অন্যদিকে মেয়ের জন্মকে দুঃখজনক হিসেবে দেখি। এই বৈপরীত্য থেকে বের না হলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটি নতুন উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি, ‘সন্তান মানেই আশীর্বাদ, হোক সে ছেলে বা মেয়ে।’




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন