বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিক্ষেত্র ‘বিল ডাকাতিয়া’। বিলটি খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি নিম্নাঞ্চল, গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা বিধৌত বদ্বীপীয় সমভূমি। এর আশীর্বাদে এ এলাকায় কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি এবং বর্ণাঢ্য সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করত। খুলনা ও যশোরের ছয়টি উপজেলার অভ্যন্তরে প্রায় ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে গঠিত বিল ডাকাতিয়া, মানুষের কাছে এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এবারের বর্ষা মৌসুমে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডাকাতিয়া বিলের জলাবদ্ধতা। বিল পাড়ের মানুষ হতাশাগ্রস্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করায়, বিল ডাকাতিয়া হয়ে উঠেছে এলাকার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তথা নিয়ন্ত্রক। বিষয়টি এতই গুরুত্ব পাচ্ছে যে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রধান আশ্বাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসন’।
১৯৮৪ সালের বন্যায় ১২ বছরের জলাবদ্ধতার পর ১৯৯২-৯৩ সালে ২২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ ছাড়া শলুয়া স্লুইসগেট থেকে কৈয়া নদী খনন এবং শলুয়া থেকে বিল ডাকাতিয়ার মাঝখান দিয়ে ফুলতলার পিপরাইল গ্রাম পর্যন্ত ৮০ ফুট চওড়া খাল খননের পর বিলের পানি নিষ্কাশন শুরু হয়। এরপর কয়েক বছর মোটামুটি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়ে ‘অভিশাপ’ কাটিয়ে বিল ডাকাতিয়া হয়ে ওঠে ‘আশীর্বাদস্বরূপ’। ২০১৭ সালে আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দিলে দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো); কিন্তু জমির মধ্য দিয়ে ১১টি নদী প্রবাহিত হলেও সম্প্রতি শোলমারী স্লুইস গেটে পলি পড়ে কপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং অপর ভদ্রা নদীতে পলি পড়ে আবারও ভরাট হওয়ায় পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। অন্যদিকে উত্তরের ভুলোপাতা বিল উঁচু হওয়ায় এ বিলের সমুদয় পানি খাল বেয়ে নেমে আসছে ডাকাতিয়ার বিলে; সে কারণে দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিল ডাকাতিয়ার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতায় চাষিরা বিপাকে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে পেটের অসুখ, আমাশয়, জ্বর, আন্ত্রিক ও চর্মরোগ। জলাবদ্ধতা, অধিক লবণাক্ততা ও অবক্ষেপণ এই এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। পাখ-পাখালি ও গরু-ছাগলের মতো গৃহপালিত পশুর অনুকূল পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। মাঠ-ঘাট, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, ধান-সবজির ক্ষেত, বসতবাড়িগুলো পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। চারিদিকে পানি জমায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না, বিধায় শিক্ষা বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকায় খুন-খারাবি, সন্ত্রাসী কর্মকা-, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জুয়ার আসর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যুবসমাজ নৈতিক অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষের মনে নেই শান্তি। ঘেরের আইলে থাকে সবজি, আর ঘেরে থাকে মাছ। অতিবর্ষণে সবজিসহ প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমির চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জমি থাকলেও বসুরাবাদ, আমভিটা, মুজারঘঘুটা, কৃষ্ণনগর, শলুয়া, দেড়–লি, বটবেড়া, পিপরাইল, ছাতিয়ানি, ধোপাখোলা, পঠিয়াবান্দা, মশিয়ালীসহ এ অঞ্চলের মৎস্য চাষি ও কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে অনাহারে ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে।
অপরদিকে ব্যাংক, এনজিও, বিভিন্ন সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া কৃষকদের উপর কিস্তির চাপ সৃষ্টি করায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এবার বৃষ্টির আধিক্যতা কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতিকে তরান্বিত করায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এলাকার আপমর জনসাধারণ। অথচ এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনাপূর্ণ মৎস্যঘেরশিল্প। ২০১৯ সালে মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি হিসাবে এলাকায় প্রায় ১৮ হাজার মাছের ঘেরের মধ্যে মাত্র ৩২টি ঘের নিবন্ধিত। অধিকাংশ ঘেরমালিক এই নীতিমালার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। নীতিমালায় বলা আছে, ঘেরের আয়তন সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর হবে (সমবায় ভিত্তিতে ৫০ হেক্টর), কিন্তু বাস্তবে ঘেরের আয়তন ২০০ হেক্টরেরও বেশি। ঘেরের মাঝখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই, বরং একের পর এক বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ রুদ্ধ করা হয়েছে।
অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঐ এলাকার উজান অঞ্চলে বিভিন্ন নদীর প্রবাহ আকস্মিকভাবে কমে যাওয়া, বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রক খালসমূহের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং চিংড়ি ঘেরগুলো প্রভাবশালীদের দ্বারা যথেচ্ছভাবে পানি প্রবাহের ভিন্নমুখীকরণ। তাছাড়া ঘেরমালিকেরা নদীর পাড়, সরকারি খাল ও সড়কের পাশে ঘেরের বাঁধ গড়ে তুলেছেন। এভাবে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই পরিস্থিতির জন্য শুধু ঘেরমালিকেরা নন, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ও দায়ী।
গত ২২ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ভবদহ স্লুইসগেট ২১ ভেন্ট এলাকা পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। খুলনা জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সময় সরকারের কর্তাব্যক্তিগণ এলাকার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান হয়নি। বারবার সরকারের বদল হয়েছে, তবে ভাগ্যের বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হতে পারেনি হতভাগা কৃষি নির্ভর এলাকাবাসী! অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এ সমস্যা সমাধানে আশায় বুক বেঁধেছে ডাকাতিয়া বিল পাড়ের কৃষিজীবী অসহায় মানুষ। সম্প্রতি শোলমারী স্লুইজ গেটে দুটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সেচ মেশিন স্থাপন করা হয়েছে; কিন্তু ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে গঠিত বিলটির পানি নিষ্কাশনে নামমাত্র দুটি সেচ মেশিন স্থাপন এলাকাবাসীর সাথে প্রহসনের সামিল বলে অনেকেই মনে করছেন।
সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপে আফিলগেট এলাকায় ভৈরব নদের সাথে ডাকাতিয়া বিলের সংযোগ খাল খনন, শোলমারী ও ভদ্রা নদীর পলি অপসারণ, শলুয়া স্লুইসগেট থেকে কৈয়া নদী পুনঃখননসহ সকল স্লুইসগেটের পলি অপসারণ এবং সরকারি নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিলের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান চান এলাকার খেটে খাওয়া মানুষগুলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে; ডাকাতিয়া বিল এলাকায় তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা, প্রকাশ করছেন পরিবেশবাদীগণ।
এদিকে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভের জন্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সর্বপ্রধান আশ্বাসের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসন’। ডাকাতিয়া বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাসে যিনি জনগণের সবচেয়ে বেশি আস্থা অর্জনে সক্ষম হবেন, তাঁর উপরই ফুলতলা-ডুমুরিয়াবাসী খুলনা-৫ আসনের দায়িত্বভার ন্যাস্ত করবেন; এমনটিই মনে করেন সমাজ সংস্কারক, পরিবেশবাদী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ছাত্র-শিক্ষক, দিনমুজুরসহ সর্বমহল। আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যিনি আশ^াস রক্ষায় ব্যর্থ হবেন; তিনি পরবর্তীতে এলাকার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়তে পারেন; এমন আশংঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ফলে ডাকাতিয়া বিলের জলাবদ্ধতা নিরসন ইস্যুটি হয়ে উঠেছে ফুলতলা-ডুমুরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি এবং নিয়ন্ত্রক। সমস্যাটি দূরীকরণের মাধ্যমেই এলাকার শিক্ষার মানোন্নয়ন, চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী কর্মকা- দূরীকরণ এবং দারিদ্রতা নিরসন করা সম্ভব। নিরবে নিভৃতে এলাকার গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকের আসনটি দখল করে আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডাকাতিয়া বিল। তবে জাতীয় নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকলে বিলের উপর নির্ভরশীল মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে উঠবে! অতিসত্ত্বর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের একান্ত দাবি। জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরসন হলে মানুষের মধ্যে আবারও ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য, দূর হবে দারিদ্রতা, শিক্ষার প্রসার ঘটবে এবং কর্মসংস্থানের ফলে নৈতিক অবক্ষয় থেকে রেহাই পেতে পারে সংশ্লিষ্ট এলাকার যুবসমাজ।
লেখক ঃ শিক্ষক অ্যাম্বাসেডর ও প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ।

