সোমবার । ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২

দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত বনাম বাজার মনিটরিংয়ে নিরবতা

আবদুল কাদের খান

জীবনানন্দের ভাষায় ‘মরা মাস’। এটি এখন কার্তিকের মন্বন্তরের দেশ! কার্তিকের প্রথম দশকও অতিক্রান্ত হয়েছে। গ্রাম কিংবা শহরে, সর্বত্র অঘোষিত ‘মিনি মন্বন্তর’ বিরাজ করছে। গ্রাম অঞ্চলে ভাদ্র আশ্বিন মাসে প্রবল বর্ষণের কারণে, জলাবদ্ধতা বিরাজ করছে সর্বত্র। খেটে খাওয়া মানুষের হাতে এ মুহূর্তে টাকা পয়সার দারুন ঘাটতি! যাকে বলে ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ অবস্থা। টানাটানির সংসারে সীমিত আয়ের কৃষক, দিনমজুর ও প্রান্তিক মানুষের দিন কাটছে যথেষ্ট বিড়ম্বনার মধ্যে।

দেনন্দিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ মেলতেই চোখে পড়ছে— ‘সবজির বাজার লাগামহীন, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, মাছ, মাংস, রসুন, মসলা ও ভোজ্য তেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী।’ খবরে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে ২ মাস ধরে অগ্নিমূল্য ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সহযোগী পত্রিকার প্রতিবেদকের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, কেজি ৮০ টাকার উপরে বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে। বৃষ্টির অজুহাতে কাঁচা সবজির মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কারণে দামের ব্যারোমিটার আর নিচে নামছে না। পক্ষকাল আগে সবজি দোকানদাররা ক্রেতাদের বলেছিলেন, আকাশের মেঘ বৃষ্টি কমলে কাঁচা সবজির আমদানি বাড়বে, মূল্য কমবে। কিন্তু কার্তিকের অর্ধেক পার হওয়ার পথে এখনো ওই কথার কোনো যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শীতের শাকসবজি কাঁচা তরকারি আমদানি বাড়লেও কোনো অদৃশ্য অজ্ঞাত কারণে মূল্যের অধিক গতির ঘোড়াকে নাগালে আনা সম্ভব হচ্ছে না!

শাক সবজির অগ্নি মূল্যের ভয়াবহ দুর্গতির চিত্রের পাশাপাশি মাছ, মাংস, তেল, মসলা, জিওে, আদা, ডাল, রসুন এসবের মূল্যও শনৈঃ শনৈঃ বাড়ছে। সাধারণ মানুষের আয় সীমিত। তাদের পিঠ দেয়ালেই ঠেকে গেছে। বাজারের ব্যবসায়ীদের গদ বাধা বক্তব্য–ঋতু পরিবর্তন ও পণ্যের সরবরাহ ঘাটতিই পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণ! এদিকে বাজার পর্যবেক্ষণে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, দিন যতই যাচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রেতারা সর্বক্ষেত্রে জিম্মি হয়ে পড়ছেন! দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে সাধারণ ভোক্তারা যখন জর্জরিত, ঠিক এই মুহূর্তে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বাজার মনিটরিং টিম সবাই এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ।

বলা বাহুল্য, বাজারে শাকসবজি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দামের স্কেল তাদের ইচ্ছামতো উচ্চ রাখায় সাধারণ, বিত্তহীন ও অসচ্ছল মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।
মধ্যস্বত্বভোগী এইসব ব্যবসায়ী মানুষদের ব্যাপারে প্রশাসনের সক্রিয় নজরদারি থাকলে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা একটু কমতো। কিন্তু কোথাও কারো সাড়াশব্দ নেই। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে শাক-সবজির সরবরাহ বাড়লেও অদৃশ্য কারণে তার মূল্য এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। তাই ভোক্তারা প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে অসাধু অধিক মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীদের কালো হাতের কারসাজির কারণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান বা তৎপরতা কোনো এক আশ্চর্য জাদু মন্ত্র বলে থেমে রয়েছে।

গত ২৪ অক্টোবর ২০২৪ শুক্রবার পর্যন্ত ভোজ্য সয়াবিন তেলের মূল্য অপরিবর্তিত থাকলেও অন্যান্য পণ্যের মূল্য ছিল লাগামছাড়া। ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, মাংসের বাজার অপরিবর্তিত থাকলেও ভেজাল পন্যের রমরমা বাণিজ্য তার বিশাল জিহ্বা বাড়িয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেই চলেছে। বোতলজাত ভোজ্য সয়াবিন ফ্রেশ, তীর বসুন্ধরা ৫ লিটার বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯২০ টাকা দরে। সেই হিসেবে প্রতি লিটারের মূল্য দাঁড়ায় ১৮৪ টাকা। যা সংগ্রহ করা অসচ্ছল বা নি¤œ আয়ের মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর। তারা দোকানের কাছ থেকে ২০ /২৫ টাকার তেল কিনে দৈনন্দিন রান্নাবান্নার কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। লুজ সয়াবিন কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে। অল্প আয়ের মানুষ যখন ২০-২৫ টাকার তেল কিনতে যাচ্ছে, তাদের পড়তে হচ্ছে আরো গ্লানিকর অবস্থায়!

স্থানীয় ময়লাপোতা কেসিসি সান্ধ্যবাজারে সরবরাহ ভালো থাকলেও ১০০ থেকে ১২০ টাকার কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ২৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের তুলনায় কোন বৃষ্টি-বাদলা না থাকলেও বেগুন, কাঁচা মরিচ, ফুলকপি, উচ্ছে, ঢেড়শ, ঝিঙে, টমেটো, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, কুশি, কাঁকরোল, আলু, গাজর, কাঁচকলা এবং শীতকালীন সদ্য উঠা সিম প্রত্যেকটির মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নাগালে নেই বললেই চলে। মসুরের ডালের বাজারেও অজ্ঞাত রহস্যজনক কারণে অস্থিরতা চলছে। চালের দাম দীর্ঘদিন ধরে যখন তখন ওঠানামা চলছে!
সে ব্যাপারে বাজার মনিটরিং বা যথাযথ তদারকি কর্তৃপক্ষের যেন কোনো দায় নেই বলে মনে হয়। দুই মাসের ব্যবধানে চালের মূল্য কেজি প্রতি চার পাঁচ টাকা বৃদ্ধি পেলেও ব্যবসায়ী মজুতদারদের খামখেয়ালিপনা ঠেকানোর কোনো কার্যক্রম না থাকায় ক্রেতারা বাজারে এদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে নিরীহ বলির পাঠা হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকছে না।

সাধারণ মানুষের রান্নার কমন পণ্য ডিমের বাজারেও আগুন। বেশ কিছুদিন লেয়ার মুরগির ডিমের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ইদানিং তার দামও বেড়েছে চোখে পড়ার মত। প্রতিহালি লেয়ার মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৮ টাকা দরে। দেশি মুরগি এবং হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে হালি। বাজারে গরুর মাংসের চিত্র বড়ই বিচিত্র! সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অজ্ঞাত কারণে গরুর মাংসের দাম বাড়ছে বৈ কোনোভাবেই কমছে না। চড়াদামে গরুর মাংস বিক্রি হওয়ায় নি¤œ মধ্য আয়ের মানুষের পক্ষে পণ্যটি ক্রয় করা প্রায় শখের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭২০ টাকা থেকে সাড়ে সাতশ টাকা, তারপরও কসাইদের ম্যাজিক হাতের কারণে প্রতি কেজি মাংসে ২৫০ গ্রাম হাড় বা উচ্ছিষ্ট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এইসব পন্য ক্রয় বিক্রয়ের সময় সরকারি কোনো এজেন্সিই উপস্থিত থাকেন না বলে জনদুর্ভোগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কসাইদের স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রাও সমান তালে বেড়ে চলেছে।

বাজারদরের এই চিত্র বিভাগীয় শহর মহানগরী খুলনার প্রতিটি বাজারে অপরিবর্তনীয়ভাবে বিরাজ করছে। নগরীর এপ্রোস রোড, রুপসা কেসিসি মার্কেট, নতুন বাজার মিস্ত্রিপাড়া বাজার, দোলখোলা বাজার, গল্লামারি ফুটপাত বাজার, কিংবা নিরালা কাঁচা বাজারের চিত্র একই রকম। নিত্যদিন বাজারে কিনা কাটা করতে গিয়ে গলদধর্ম হওয়া মানুষের মুখে শুধু একটি কথা বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করবে যারা ওরা কোথায়? বাজারের অধিকাংশ দোকানে পণ্যতালিকা টানানো হয় না! ইচ্ছামাফিক দাম নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের নাজুক অবস্থায় ভুক্তভোগীরা মনে করছেন চাল ডাল তেল পেঁয়াজসহ প্রত্যেক ধরনের শাকসবজি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতি প্রতিহত করতে হলে অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অন্ততপক্ষে পক্ষকালে একবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের চাবুক মেরে ওদেরকে অবশ্যই শায়েস্তা করা দরকার। কর্তৃপক্ষই ভালো জানেন, এরপর উনারা কি করবেন!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন