শেরে বাংলার বাবা বানারীপাড়ার চাখারে শেরে বাংলার বাবা পিতা কাজী ওয়াজেদ আলী এসে বসতি গড়েন। তিনি বানরীপাড়া থানার চাখার গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশাল জেলা স্কুল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৮৯১ সালে কলকতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এফএ পাস করার পর তিনি গণিত, বসায়ন ও পদার্থবিদ্যা এ তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করেন। বাঙালি জাতির আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। এ মহান নেতা এদেশের গরিব-দুখী মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সারাজীবন তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ ছিলেন, ছাত্রজীনে তিনি তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ঝালকাঠীর রাজাপুর থানার সাতুড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি পৈত্রিক নিবাস পটুয়াখালীর বাউফলে।
বিএ পাস করার পর এমএ ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, ‘মুসলমান ছাত্ররা অংক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ কে ফজলুল হকের জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অংক শাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অংক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি দাবা খেলতে ও সাঁতার কাটতে পছন্দ করতেন। বৃহত্তর বরিশালে তার বাবা ছিলেন প্রথম গ্রাজুয়েট এবং তিনি ছিলেন দ্বিতীয় গ্রাজুয়েট।
এ সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি এ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য রাজনীতিতে নামেন। তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার পদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সদস্য নির্বাচিত হন। এভাবেই তার রাজনীতি শুরু। ১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর ১৯১৭ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর সাধারণ সম্পাদক হন। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সময়ে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯১৮-১৯ সালে জওহরলাল নেহেরু ছিলেন ফজলুল হকের ব্যক্তিগত সচিব।
১৯৩৭-এর নির্বাচনে শেরে বাংলা ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচনে জিতলে তিনি জমিদারি প্রথা চিরতরে উচ্ছেদ করবেন। তিনি যাতে নির্বাচিত হতে না পারেন তার জন্য সারা বাংলাদেশ আর কলকাতার জমিদাররা একত্র হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। কৃষকরা তাদের নেতা শেরে বাংলাকে ভোট দিয়েছেন।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বিল, মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলার গভর্নরের কাছ থেকে বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য, মুসলিম এডুকেশন ফান্ড গঠন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল উত্থাপন, বরিশালে চাখার কলেজ, আদিনা কলেজ, মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কলকাতায় লেডি ব্রেবোন কলেজ ও ঢাকায় ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠা, কলকাতার বেকার হোস্টেল কারমাইকেল হোস্টেল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এ মহান নেতা।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফা যা ১৯৪০ সালের এ কে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়। ১৯৪০ সালের ২২-২৪ মার্চ লাহোরের ইকবাল পার্কে মুসলিম লীগের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি তার প্রস্তাবে বলেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বাস্তবতায় হিন্দু মুসলিম একসাথে বসবাস অসম্ভব। সমাধান হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র এবং পূর্বাঞ্চলে বাংলা ও আসাম নিয়ে আরেকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবের ‘খতনা’ করার ফলে বাঙালিদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে।
১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদে অনাস্থার যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। এ কে ফজলুল হক ১৯৯ জন এবং আতাউর রহমান খান ১০৫ জন সদস্যের সমর্থন পান। অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হল। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল। এখান থেকে বোঝা গেল শেরে বাংলার জনপ্রিয়তা কতটা উঁচুতে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ, প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করা, জমিদারি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করাসহ উপমহাদেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছিলেন এ মহান নেতা।
অসীম সাহসী এই মানুষটি আমাদেরকে সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন। বাঙালি জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। তিনি বলেছেন, “যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কীভাবে শিখবে?”

