পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য (সুরা জারিয়াত: ৫৬)।” আল্লাহ আরও বলেন, “তাদেরকে তো এছাড়া আর কোনো হুকুম দেওয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বিনকে (সার্বিক আনুগত্যকে) একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করবে (সুরা বাইয়্যানা: ৫)।”
সকল নবি ও রাসুলগণকে প্রেরণ করা হয়েছিল মানবজাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির কাছে রাসুল পাঠিয়েছি যাতে (তাদের কাছে সে দাওয়াত দিতে পারে) তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে (বহু মাবুদ ও মূর্তি পূজা) বর্জন করো (সুরা নাহল: ৩৬)।”
পৃথিবীতে মানুষের মূল দায়িত্ব হলো আল্লাহর ইবাদত করা। ‘ইবাদত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আনুগত্য করা, দাসত্ব করা। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যই হলো ইবাদত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলতে প্রকৃত ভালোবাসার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালার সামনে একনিষ্ঠভাবে বিনয়ী হওয়াকে বুঝায়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, “ইবাদতের মূল অর্থ হলো বিনয়।”
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, “ইবাদত হচ্ছে বিনয়ের সাথে আনুগত্য (মির’আত: ১/৬১ পৃঃ)।”
মনীষীগণ ইবাদতের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নি¤েœ সেগুলো আলোচনা করা হলো :
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) তাঁর ‘আল-উবূদিয়াহ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ইবাদত একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। যা আল্লাহ পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট হন এমন সব প্রকাশ্য ও গোপনীয় কথা ও কাজ ইবাদত শব্দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত (আল-উবূদিয়াহ, পৃঃ ২৩)।’
শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন, “ইবাদত হচ্ছে আল্লাহর একাত্ম প্রকাশ করা এবং তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতঃ তাঁর আনুগত্য করা (মাজমূ‘ ফাতাওয়া বিন বায, ১/৩২৪, ২৭/৫৯)।” তিনি আরও বলেন, “ইবাদত হচ্ছে আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাঁর জন্য বিনয় ও ন¤্রতা প্রকাশ করা (মাজমূ‘ ফাতাওয়া বিন বায, ৭/৮৭)।” মোটকথা আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ প্রতিপালনের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করাই ইবাদত। আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তদনুযায়ী পার্থিব জীবনের যাবতীয় কর্মকা- পরিচালনা করা মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। যা আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে শামিল।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন আমরা প্রতিদান লাভ করতে পারি এবং তাঁর আজাব থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। মুসলিম মানেই আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য এবং বিশুদ্ধ নিয়ত লালনের প্রতি আদিষ্ট। এমনকি সাধারণ বৈধ কাজগুলোতেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করাই কাম্য। তবেই সহজে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য হাসিল হবে। তাইতো আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে নবি! আপনি বলুন, ‘আমার নামাজ, আমার ইবাদত এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য ’ (সুরা আনআম: ১৬২)।”
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করো যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও। যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে, তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন। কাজেই তোমরা জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না (সুরা বাকারা: ২১-২২)।”
মানুষের পরিচয় হলো, মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধির জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু আল্লাহর জন্য। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাকে কেবলমাত্র আমার নিজের জন্য সৃষ্টি করেছি, আর অন্য সবকিছুকে সৃষ্টি করেছি তোমার জন্য। তোমার ওপর আমার যে অধিকার আছে, তা তুমি যেন কখনো ভুলে না যাও। যে-সব জিনিস আমি তোমার জন্য সৃষ্টি করেছি তাতে যেন কখনো এতটা মনোযোগী হয়ে না যাও, যাতে তোমাকে যার জন্য সৃষ্টি করেছি, তার কথা ভুলে যাবে। হে মানুষ! আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য সৃষ্টি করেছি। এটাকে তুমি খেলা মনে করো না। আমি তো তোমার রিজিক এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পরিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। অতএব তুমি হতাশাগ্রস্ত হবে না। হে মানুষ! তুমি আমাকে পেতে চাইবে, তুমি আমাকে পাবে, যদি তুমি আমাকে পেয়ে যাও তবে তো সব কিছু পেয়ে গেলে। কিছুরই অভাব থাকবে না। কিন্তু তুমি যদি আমাকে হারিয়ে ফেলো, তাহলে তুমি হলে সর্বহারা। আমি যেন হই তোমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়।’
আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর বিভিন্ন ইবাদত ফরজ করেছেন, যথা : নামাজ, রোজা, জাকাত এবং হজ। এছাড়াও ইবাদতের মধ্যে আরও রয়েছে আল্লাহর জিকির করা, দোয়া করা, তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা, কুরআন তেলাওয়াত, বাবা-মায়ের সেবা, আত্মীয়তা রক্ষা, আমানত আদায় করা, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, দান-সদকা করা, রোগীর সেবা করা, ইয়াতিম, মিসকিনের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা, হালাল উপার্জন ইত্যাদি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর যে-সব ইবাদত ফরজ করেছেন এবং যে-সব হারাম বস্তু থেকে বেঁচে থাকতে নিষেধ করেছেন, তা আমাদের ওপর আল্লাহর হকসমূহের কতিপয় হক। কেননা বান্দার ওপর আল্লাহর হক হলো, তাকে সর্বদা স্মরণ করা, ভুলে না যাওয়া, তার আনুগত্য করা, অবাধ্য না হওয়া, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অকৃতজ্ঞ না হওয়া। সন্তান, পরিবার, ধন-সম্পদ ও নিজের জীবন অপেক্ষা তাকে বেশি ভালোবাসা এবং সবকিছুর ওপর তার ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া। আর বান্দা তাঁর কাছে পরিপূর্ণরূপে বিনয়ী ও অবনত হবে এবং তার হেদায়েত পেয়ে সর্বাধিক খুশি হবে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালাই সত্ত্বাগতভাবে সব ইবাদতের হকদার।
একজন মুমিন মুসলমান দিনে-রাতে অন্তত পাঁচ বার নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করে। তাছাড়া সুন্নত ও নফল নামাজসহ অন্যান্য জিকির-আজকার তো রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো (সুরা আহজাব: ৪১-৪২)।”
একজন মুসলিমের সারাটা জীবনই ইবাদত। তাকে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা জীবন আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দিতে হবে। জীবনের একটি মুহূর্তও সে ইবাদতের বাইরে কাটাতে পারবে না। তাকে একদিকে যেমন আল্লাহর ইবাদতেই সমগ্র জীবন কাটাতে হবে, অন্যদিকে আল্লাহর ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করা যাবে না এবং অন্য কারো সামনে মাথানত করা যাবে না। আর তাহলেই মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না (সুরা আন-নিসা: ৩৬)।”
মুমিন ব্যক্তি সমগ্র জীবনে আল্লাহর ইবাদতে রত না থাকলে অথবা জীবনের কোনো একটু সময়ও অন্যের ইবাদত করলে আল্লাহ তায়ালার মানুষ ও জিন জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না। সুতরাং মানব জাতিকে আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত অন্য কোনো কিছু যেমন করা যাবে না, তেমনি আল্লাহর ইবাদতে অন্য কাউকে শরিকও করা যাবে না এবং অন্য কারো সামনে মাথানত করা যাবে না।
আল্লাহ তায়ালা ইবাদতের সময়সীমাও ঘোষণা করেছেন। কখনো এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। বরং দুনিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পরকালের সূচনার সময়টুকু পর্যন্ত ইবাদতের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এটাই ইবাদতের শেষ সময়। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক রাসুলের জন্য আমৃত্যু ইবাদত করাকে অপরিহার্য করেছেন। যেমন, তিনি বলেন, “আর তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো, যে পর্যন্ত তোমার কাছে সুনিশ্চিত ক্ষণ (মৃত্যু) না আসে (সুরা হিজর: ৯৯)।”
কাজেই যতদিন সূর্য উদিত হবে, নতুন দিনের সূচনা হবে, ততদিন আল্লাহর ইবাদতের কথা ভোলা যাবে না; বরং বারবার স্মরণ করতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন।
লেখক : উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (অব:), উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা। মোবাইল নাম্বার-০১৯২৩-৫৮৭২৫৬

