সোমবার । ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২

ইউরোপের ঘড়ির কাঁটায় জীবনযাপনের দর্শন : বাংলাদেশের সঙ্গে সময়ের ব্যবধান এক ঘন্টা বাড়ছে

নিয়াজ মাহমুদ

“সময়ই জীবন”- এই প্রবাদটি ইউরোপে যেন নিছক কোনো বাণী নয়, বরং জীবনের এক নিখুঁত অনুশাসন। যেখানে আমরা সময়ের পেছনে দৌঁড়াই, সেখানে তারা সময়কে ব্যবহার করে নিজেদের জীবনের ছন্দ নির্ধারণ করে। রবিবার রাত ৩টায় ইউরোপ জুড়ে আবারও ঘটেছে সেই বার্ষিক পরিবর্তন-ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে আনা হয়েছে এক ঘণ্টা। সময় এখন তাদের দেশে কিছুটা ধীর, সূর্য দেরিতে ওঠে, তাড়াতাড়ি অস্ত যায়- তাই রাত লম্বা হয়। এটিই ‘উইন্টার টাইম’- বা শীতকালীন সময়, যা ইউরোপবাসীর শৃঙ্খলিত জীবনের এক দৃষ্টিনন্দন প্রতীক।

ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রিয়া কিংবা সুইডেন- সবাই যেন এক সুতোয় বাঁধা। রাত ৩টা বাজতেই সময় থেমে গেল ২টায়। ঘড়ি ফিরে এল এক ঘণ্টা পেছনে, কিন্তু তাদের সমাজ এগিয়ে গেল আরও একধাপ শৃঙ্খলার দিকে। এই পরিবর্তন কেবল সময়ের নয়; এটি এক সভ্যতার অভ্যাস, একটি সংস্কৃতি, যেখানে প্রতিটি মিনিটের মূল্য নির্ধারিত হয় জাতীয় অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মজীবনের সূচি পর্যন্ত।

সময় পরিবর্তনের এই নিয়ম ইউরোপে চলে আসছে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। এর মূল লক্ষ্য একটাই- প্রাকৃতিক আলোকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা।

গ্রীষ্মে সূর্য ওঠে আগেভাগে, তাই মানুষও ঘুম থেকে ওঠে আগে, ঘড়ি এগিয়ে নিয়ে আসে কাজের সময়। আর শীতে যখন সূর্য দেরিতে ওঠে, তখন তারা ঘড়ি পিছিয়ে নেয়, যেন দিন ও রাতের ছন্দের সঙ্গে মানুষের কর্মঘণ্টা মিলে যায়।

এই ধারণার জন্ম ১৭৮৪ সালে- আমেরিকান দার্শনিক বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের কলমে। তিনি লিখেছিলেন, “মানুষ যদি সূর্যের আলোয় বেশি সময় কাটায়, তবে মোমবাতির তেল কম লাগবে।” শক্তি সঞ্চয়ের এই ভাবনাই পরে রূপ নেয় Daylight Saving Time ধারণায়।

কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে আসে ১৯১৬ সালে, জার্মানির উদ্যোগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জ্বালানি বাঁচানোর প্রয়োজনে তারা গ্রীষ্মকালীন সময় চালু করে। পরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এই পদ্ধতি গ্রহণ করে। আজ সেই সময় পরিবর্তনের অনুশীলন শুধু শক্তি সঞ্চয়ের উপায় নয়- এটি ইউরোপীয় সমাজে পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ও সময় ব্যবস্থাপনার এক অনন্য প্রতীক।

ইউরোপে সময় মানে কেবল ঘড়ির কাঁটা নয়- এটি একটি সংস্কৃতি, এক ধরনের নাগরিক শৃঙ্খলা।

এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে বা পিছিয়ে দেওয়া মানে কেবল কাজের সূচি পাল্টানো নয়; এর সঙ্গে বদলে যায় পরিবহন সূচি, অফিস সময়, স্কুলের ছুটি, এমনকি টেলিভিশন সম্প্রচারের সময়ও।

তবু কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। কারণ সবাই জানে- সময় বদল মানেই সমাজ বদল নয়; বরং একই ছন্দে এগিয়ে চলার আরেকটি প্রস্তুতি।

অন্যদিকে, এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপের সময় পার্থক্যও পাল্টে যায়।

এখন থেকে সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান টাইম (CET) অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য হবে পাঁচ ঘণ্টা, আর ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান টাইম (EET) অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে পার্থক্য চার ঘণ্টা। যুক্তরাজ্য ও পর্তুগালের সঙ্গে সময়ের ব্যবধান এখন ছয় ঘণ্টা।

একটি সময়ের পার্থক্য, কিন্তু এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মানবসমাজের অদ্ভুত সমন্বয়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে গেলেও সময়ের সঙ্গে ইউরোপীয় জীবনযাত্রা ঘুরে যায় না; বরং আরও নিখুঁত হয়।

ফ্রান্সে এই সময় পরিবর্তনের ইতিহাস বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। ১৯১৬ সালের ১৪ জুন, সংসদীয় ভোটের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন সময় চালু হয় সেখানে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন দেশটি জার্মান দখলে চলে যায়, তখন এক সময়- দুটি সময়- এমন বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে, ফরাসি রেলওয়ে SNCF পর্যন্ত সমস্যায় পড়ে যায়।

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে ফ্রান্স পুনরায় নিজস্ব সময় ফিরে পায়, তবে রাখে সেই ১ ঘণ্টা এগিয়ে থাকার অভ্যাস- যা আজও বহমান।

১৯৭৩ সালের পেট্রোল সংকটের সময় আবারও ফিরে আসে এই আলোচনায়। শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতি বছরের মার্চের শেষ রবিবার ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে অক্টোবরের শেষ রবিবারে আবার ঘড়ি ফিরিয়ে আনা হয় মূল সময়ধারায়। একটি সিদ্ধান্ত, যা শুরু হয়েছিল শক্তি বাঁচানোর জন্য- আজ সেটি হয়ে উঠেছে ইউরোপীয় জীবনের ছন্দের অংশ।

এখন প্রশ্ন জাগে- প্রকৃত সময় কোনটি? গ্রীষ্মকালীন না শীতকালীন? বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সময় হচ্ছে শীতকালীন সময়- কারণ এটি সূর্যের প্রকৃত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষত ফ্রান্সে, ৭০ শতাংশ নাগরিক চান গ্রীষ্মকালীন সময় স্থায়ী হোক। কারণ সূর্যের আলোয় দীর্ঘ সন্ধ্যা তাদের জীবনকে আরও প্রফুল্ল করে তোলে।

দুপুর শেষে রোদে বসে কফি খাওয়া, সন্ধ্যার পর হাঁটতে বের হওয়া, কিংবা রাত অবধি আলোয় ভরা শহরের রাস্তায় হাঁটা- এগুলোই ইউরোপীয় জীবনের সৌন্দর্য, যা গ্রীষ্মকালীন সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে।

এক ঘণ্টা সময়ের পরিবর্তনে ইউরোপে কেবল ঘড়িই বদলায় না- বদলায় মানুষের মনোভাবও।

তারা জানে, সময়কে সম্মান করা মানে জীবনকে সম্মান করা।

যে সমাজ নিজের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে সমাজই পারে নিজের ভবিষ্যৎকে গড়তে।

এ কারণেই ইউরোপে সময় মানে দায়িত্ব, শৃঙ্খলা, আর অভ্যাসের নান্দনিকতা।

আমরা, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষরা, প্রায়ই বলি- “সময় নেই।” অথচ সময় তো আছে, নেই শুধু ব্যবস্থাপনা।

যেখানে ইউরোপিয়ানরা প্রতি বছর ঘড়ি বদলে জীবনকে সাজিয়ে নেয়, আমরা সেখানে অনেক সময় সময়ের পেছনেই পড়ে থাকি। তাদের কাছে সময় একটি যন্ত্র নয়, বরং এক জীবন্ত সঙ্গী- যার সঙ্গে তারা প্রতিদিন নতুনভাবে পরিচিত হয়।

ইউরোপের সময় পরিবর্তনের এই গল্প আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে-সময়কে বদলানো যায় না, কিন্তু সময়ের ব্যবস্থাপনা বদলানো যায়। যে সমাজ তা পারে, তারাই এগিয়ে যায় উন্নতির পথে।

আমাদেরও উচিত সময়ের প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা-অফিসে, স্কুলে, কিংবা দৈনন্দিন জীবনে। কারণ সময়ের শৃঙ্খলা কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি এক জাতির চরিত্র।

ইউরোপের ঘড়ির কাঁটা যখন পিছিয়ে যায়, তখন তারা সময় হারায় না— বরং সময়কে পুনরুদ্ধার করে।

আমরাও যদি একদিন শিখতে পারি সময়কে আয়ত্ত করার এই শিল্প, তবে হয়তো আমরা বলতেও পারব-
“সময়কে নয়, সময় আমাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে।”

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন