সোমবার । ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২

সৌরভের গৌরবের একটি নাম

কাজী মোতাহার রহমান

ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ৭৩ বছর আগে যারা খুলনায় মিছিল সমাবেশ-এর আয়োজন করতেন তাদের একজন এম নুরুল ইসলাম। তিনি আজও আছেন মিছিল-সমাবেশে। সেদিন তিনি ছিলেন টগবগে যুবক, কিন্তু আজ তরুণদের অনুপ্রেরণা।

ঢাকার সঙ্গে সংগতি রেখে খুলনা ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলতে সে দিন হাতে গোনা কয়েকজন যুবক শ্রম ও মেধা নিয়োগ করেন। ঢাকার অনুরূপ খুলনায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়। হরতাল সফল করতে যারা এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণ ও ছাত্র নিহত হওয়ার প্রতিবাদে খুলনার যুব সমাজ ২৩ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করে। অবাঙালি ও মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনী মিছিলের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। ছাত্র জনতা সে আক্রমণ প্রতিহত করে। মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের সমর্থকরা ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তদের বাড়ি বাড়ি হামলা ও মারপিট করে। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ায় এম নুরুল ইসলামের নামে মামলা হয়।

তিনি রাজনৈতিক অঙ্গণে দাদু ভাই বলে পরিচিত। ১৯৩৪ সালের ২ জুলাই তিনি খুলনা শহরের বাবু খান রোডে জন্মগ্রহণ করেন। মরহুম ডা. খাদেম আহমেদ তার পিতা ও আছিয়া খাতুন তার মা। তার পৈতৃক নিবাস মাগুরা জেলার শালিখা থানার সোলাপুর গ্রাম। ১৯৪৭ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটন হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৯ সালে বিএল একাডেমি থেকে আইএ পাশ করেন। ছাত্র জীবনে তিনি নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে খুলনায় ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬২ সালে খুলনা পৌরসভার জাহানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে ন্যাপের খুলনা শহর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে মিছিলে অংশ নেন। দীর্ঘপথ হেঁটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কনসাটে উপস্থিত হন।

১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাগদলে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে খুলনা মহানগরী বিএনপি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘ সময় এই দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির মনোনয়নে খুলনা সদর আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে খুলনা-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আমৃত্যু বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি নাট্য নিকেতন, হার্ট ফাউন্ডেশন, শিল্পকলা একাডেমি, রূপসার আলাইপুর ডিগ্রি কলেজ, রূপসা কলেজ, উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি, সেন্ট জোসেফস্ হাই স্কুলের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর সফর করেছেন। বরণীয় এ রাজনীতিকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগকে অনেকেই স্বগত জানালেও প্রকাশের আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু।

২০২০ সালের ২১ অক্টোবর এই রাজনীতিক ইহকাল ত্যাগ করেন। পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় নগর বিএনপি বরণীয় এ রাজনীতিকের ত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, খুলনার রাজনীতির আলোকবর্তিকা ও বিএনপির ভিত্তি নির্মাণে অগ্রদূত। তিনি একজন নীতিনিষ্ঠ, সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ, যিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর আদর্শ, মানবিকতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বিএনপির কর্মীদের জন্য আজও অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর রাজনীতি ছিল আদর্শ, সততা ও জনগণের ভালোবাসায় গড়া। আমরা তাঁর দেখানো পথে থেকে গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারে লড়াই চালিয়ে যাব। বলেন, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করেছেন। ক্ষমতার লোভে নয়, জনগণের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। তাঁর দেখানো নীতি ও আদর্শই খুলনার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভীতকে শক্ত করেছে। এ উপলক্ষ্যে এ ত্যাগী পুরুষকে স্মরণ করে মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, তার অবদান এ অঞ্চলবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

তিনি বলেন, মরহুম ছিলেন দীর্ঘ ৭ দশকের রাজনীতির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। মানুষকে আকর্ষণ করার এক অতুলনীয় সম্মোহনী শক্তি ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ও অংশীদার ছিলেন মরহুম এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই। রাজনীতিতে সামগ্রিক ব্যর্থতা ও সাফল্য সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ছিল সাফল্যের অংশীদার অংশগ্রহণকারী সকলের এবং ব্যর্থতা যিনি নেতৃত্ব দেন তার কাঁধে বর্তায়। দাদু ভাই ছিলেন নেতাদের নেতা, রাজনীতির শিক্ষক। প্রগতিশীল রাজনীতির পুরোধা, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ছিলেন।

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন