কর্মজীবনের শুরুতেই ছিলেন শিক্ষক। পরে আইনজীবী ও রাজনীতিক। ছিলেন জনসেবক-জনপ্রতিনিধি। বিদ্যোৎসাহী হিসেবে খ্যাতিও পেয়েছেন। তার অমর সৃষ্টি খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, জিয়া হল ও বায়তুন নুর মসজিদ কমপ্লেক্স। জিয়া হল ভেঙে ফেলা হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোর নির্মাতা-উদ্যোক্তা তিনি। নিখুঁত কারিগর। তিনি মরহুম শেখ তৈয়েবুর রহমান।
জন্ম বাগেরহাট মহকুমা সদরের কররী গ্রামে। শেখ মতিউর রহমান তার পিতা এবং মরহুম সাহিদা খাতুন মা। মাতৃকোলে ভূমিষ্ঠ হন ১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর। তখন বৃটিশ জামানা। ইংরেজরাই দেশ শাসন করতেন। তৎকালীন মহকুমা সদরের মধুদিয়া ইছাময়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, পিসি কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে আইন সনদ লাভ করেন। এর আগে নিজের বিদ্যাপীঠ মধুদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দু’বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেন। সময়টা ১৯৫৮ সালে। তখন পাক জামানায় জেনারেল আইয়ুব খানের শাসন আমল, দেশে সামরিক শাসন। ১৯৬৪ সাল থেকে কয়েক বছর সম্পাদক, সহ-সভাপতি ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতি এবং ১৯৭৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮৮ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেন ন্যাপের খুলনা জেলা শাখার সভাপতির। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগদান করেন। দীর্ঘসময় বিএনপি’র কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের পর একই বছরে ২২ মে কেসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে এবং ২০০২ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি সেনেগাল, মালি, মৌরতানিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, আইভেরিকোস্ট ও সিয়েরা লিয়নের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সৌদি আরব, মিশর, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, সুইজারল্যান্ড, ইটালি, জাপান, ভারত, মালেশিয়া, মেক্সিকো, ভ্রমণ করেন।
শেখ তৈয়েবুর রহমান রাজনীতিক, আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন তেমনি বিদ্যোৎসাহী হিসেবে সমর্থন পেয়েছেন। খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল, নয়াবাটি হাজি শরিয়তউল্লাহ বিদ্যাপীঠ ও আহসানউল্লাহ কলেজের বিকাশে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। নগরীর অত্যাধুনিক বায়তুন নূর কমপ্লেক্সের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণে খুলনার নগর পিতা প্রচেষ্টা চালান। জিয়া হল নির্মাণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এসময় সকল বাঁধাকে উপেক্ষা করে এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সময়োপযোগী দায়িত্ব পালন করেন। এ কর্মবীরের স্মৃতি খুলনার অলিতে গলিতে। ওয়াসা প্রতিষ্ঠার পূর্বে বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন। নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্থাপিত জেলা নাগরিক কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন।
গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে, ৬৯ ও ৯০ এর স্বৈরশাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন। আইনজীবী হিসেবেও পেশাজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন। আইনজীবী সমিতিতে তার স্মৃতি হিসেবে রয়েছে নাম ফলক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পীর খানজাহান আলী (রহঃ) সেতু, খুমেক হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দক্ষ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সফল ও সার্থক। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯ দফা কর্মসূচির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কর্মী সমাবেশ ও জনসভায় তার হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করত। শ্রোতার মন জয় করতে বক্তা হিসেবে অতুলনীয়। তিনি বক্তৃতায় যথেষ্ট যুক্তি প্রদর্শন করে শ্রোতার মন জয় করতেন। পরবর্তীতে দলীয় কর্মীদের কাছে এটি হত উদাহরণ। প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলতে হয়, ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি এ অঞ্চলে প্রভাব ফেলে ছিলেন।
তার নির্বাচনী কৌশল ছিল ব্যতিক্রমী। রাজনীতিতে ব্যক্তিগত ইমেজ সৃষ্টি করার ঘোর বিরোধী মানুষ ছিলেন তিনি। বরাবর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নগরবাসীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন দীর্ঘ সময়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত কেসিসির দায়িত্ব পালনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। ২০০৮ সালে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হলেও তিনি নিজেকে আত্মসমর্পণ করেননি। সরকারি সিদ্ধান্ত মানলেও নিজের স্বক্রীয়তা বজায় রেখেছেন।
রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি অঙ্গনেও তার পদচারণা ছিল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। একসময় খুলনা মোহামেডন স্পোর্টিং ক্লাবের হাল ধরেছেন। কিছু সময়ের জন্য হলেও ক্লাবটি ঘুরে দাঁড়ায়। সাদা-কালো জার্সির খেলোয়াররা যেন প্রাণ ফিরে পায়। মোহামেডনের সমর্থক বাড়তে থাকে। এসবের পাশাপাশি রোটারি ক্লাব, ডায়াবেটিক সমিতি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও শিশু হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রোগীদের সেবার মান বাড়াতে সময়োপযোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
এ কর্মবীরের নামে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরির অস্তিত্ব এখন সাইনবোর্ডের মধ্যে। নেই লাইব্রেরির কাঠামো, নেই সংগৃহীত পুস্তক ও দলিলপত্র।
২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন খুলনার সাবেক এই মেয়র। চিরনিদ্রায় আছেন নিজগ্রামে। উন্নয়নের কারিগর হিসেবে শেখ তৈয়েবুর রহমান আজীবন খুলনাবাসীর শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। তাঁর সৃষ্টিতে তিনি অমর হয়ে আছেন। এ সেবকের স্মরণীয় অধ্যায় দক্ষিণ জনপদের মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, খুলনা গেজেট।
খুলনা গেজেট/এনএম

