বাহারি ঋতুচক্র। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ। আর কয়েকদিন পর হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস এবং অগ্রহায়ণের নবান্নের উৎসব শুরু হবে। খেজুর গাছের রস থেকে নলেন গুড় পাটালি, ঘরে ঘরে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যাবে।
এটি বাল্য স্মৃতির নতুন চর্চা বলতে পারেন। সমসাময়িক বাংলাদেশে এর ছিঁটে ফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই। কেউ কেউ বলতে পারেন, দেশটা কেন যে দিন দিন অচেনা হয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভীষণ কষ্ট লাগে! এখন এ দেশে নিঃশ্বাসে বিষ, বিশ্বাসেও বিষ। বলা চলে খাঁটি নির্ভেজাল বলে কিছুই আর অবশেষ রইল না।
দেশ-সমাজ নিয়ে ভাবেন এমন একজন পুরোনো বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিলো, জীবনের নানা দিক নিয়ে বহু কথা তিনি শোনালেন। তার কথা আমার মনে বেশ দাগ কেটে গেল। নিজের জীবন জিজ্ঞাসা কে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতো জেরা করলো। আমি সম্পূর্ণ ‘লা জবাব’ অর্থাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
বন্ধুর কথাটিই বলি, আসলে উদর পূর্তির জন্য ‘খাদ্য’ নামে যা খাচ্ছি, তা কি পুরোপুরি নির্ভেজাল, নাকি ভেজাল? খাদ্যের নামে প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি, বলা চলে তা পরিপূর্ণ ‘বিষ’। কি বিচিত্র দেশ! অথচ এসব দেখার কেউ নেই। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নামে মাত্র। জনগণ এ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকে পজিটিভ কোনো অ্যাকশন দেখতে পেয়েছে, এমন তথ্য কোনো অভাজন নাগরিকের কাছে নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ বলা চলে নামে মাত্র ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’- নখ দন্তহীন বাঘ যেমন নিরীহ নিষ্প্রাণ অমনি আর কি!
প্রথমে আমরা চোখ রাখি, আমাদের দেশের নগরে শহরে বন্দরে লোকালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোটেল-রেস্তোরাঁ গুলোর দিকে। হোটেল-রেস্তোরাঁ গুলোতে কর্মব্যস্ত জীবনে পানাহার করেন না এমন নাগরিক সহজে খুঁজে পাওয়া কঠিন। হোটেল রেস্তোরাঁর কাহিনি বলতে গেলে প্রথমে চোখে পড়ে ওর রন্ধনশালার কথা, নিয়োজিত কর্মচারীর কথা। সেখানে যারা টেবিলে খাদ্য পরিবেশন করে, ওদের চেহারা মেজাজ অনেককেই অবশ্যই মুগ্ধ করে। একথা যে কোনো নিন্দুকও এক বাক্যে স্বীকার করবে। তবে গলদ কি রয়েছে অন্যখানে।
রান্না বান্নার কাজে নিয়োজিত কুকার বা বাবুর্চিরা ২-৩ দিনের বাসি মাছ মাংস ডাল সবজি গরম করে খরিদ্দারের কাছে টাটকা বলে পরিবেশন করে। এই ধরনের হৃদয়হীন বিবেক বিরোধী কার্যক্রম চলছে সপ্তাহ, মাস, বছরের পর বছর ধরে। এ ধরনের অনিয়ম বাস্তবে দেখার কেউ নেই! কাল ভেদে রাজধানী শহরে বিভাগীয় শহরে কিংবা জেলা শহরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট বসিয়ে নাগরিকদের জন্য উপযোগী স্বাস্থ্যকর খাদ্যের অনুসন্ধানে ওইসব হোটেল রেস্তোরাঁয় হানা দিয়ে জেল জরিমানা করেন। তবে তা বছরে কিংবা দুই পাঁচ বছরে একবার, যা লোক দেখানোই বলা চলে। জেলা শহরের বাইরে নিবিড় অন্ধকার! বাংলাদেশের উপজেলা ইউনিয়ন কিংবা দূর গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। রোগ-শোক আদি ব্যাধি সবই বাসা বাঁধে গ্রামাঞ্চলে, গ্রাম-গঞ্জের স্বাস্থ্য অসচেতন নিরীহ মানুষের শরীরে।
খাদ্যে ভেজাল চিত্র তুলে ধরলে, ইউনিয়ন থেকে সেক্রেটারিয়েট পর্যন্ত মুহূর্তে ভূমিকম্প হয়ে যাবে! কেন বলুন তো? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য চাল ডাল তেল চিনি আটা ময়দা বিস্কুট গুড় মুড়ি মিষ্টি-সবখানেই ভেজালের রমরমা কারবার। গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো অজস্র ইটালিয়ান হোটেল অর্থাৎ রাস্তার পাশে ফুটপাতের ‘ছাবড়া হোটেলে’ যানবাহনের ধুলো বালি, পোকামাকড় মাছির সাথে একাকার হয়ে মাছ বাজার, আড়ত, ছোট কল কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকরা যে ভাত মাছ ডাল রুটি খায়, তাতে বায়ুবাহিত রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ৮০% গ্যারান্টি থাকে।
বাজারের ফলমূল দোকানের দিকে তাকালে কী দেখতে পাই? আপেল, কমলা, আঙ্গুর, মালটা, বেদানা, তরমুজ, কলা, পেয়ারা প্রভৃতি পচনশীল প্রত্যেক দ্রব্যে কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এসব দেখার বা মনিটরিং করার জন্য গ্রামাঞ্চলে কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নেই বললেই চলে! চিংড়ি মাছে ভেতর অপদ্রব্য পুশ করা হচ্ছে, মাছ ফ্রিজিং করে, বছরের পর বছর টাটকা বলে খরিদ্দার এর কাছে বিক্রি করা হচ্ছে, পরিবেশন করা হচ্ছে। ইদানীং সময়ে গ্রামাঞ্চলে ও শহরে রুগ্ন মুমূর্ষু প্রায় গবাদি পশু জবাই করে, নামিদামি হোটেলে ওই মাংস সরবরাহ সিন্ডিকেট অব্যাহত তৎপরতা চালালেও প্রতিকারের কোনো উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর!
গ্রামের কৃষিজীবী মানুষেরা সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন সবজিও তরকারিতে কীটনাশক অর্থাৎ ‘বিষ’ সকালে প্রয়োগ করে অল্পক্ষণ পর বিকালে তা উঠিয়ে বাজারে নিয়ে আসছে। বিশেষ করে বেগুন, মরিচ, পটল, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়স, বরবটি, টমেটো ও নানা জাতের শাকসবজি। এমন চিত্র সরকারি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ একটু তদন্ত করলেই বা তীক্ষ্ম নজরদারি করলে তাদের চোখে সহজ এই ধরা পড়বে। এর জন্য দোষ দেবেন কাকে? কৃষককে, না তরকারি সবজি বিক্রেতা কে, না ফল বিক্রেতাকে? ওরা তো সুলভে মুনাফা লাভের জন্য রীতি অনুযায়ী বছরের পর বছর নির্বিবাদে এসব করছে, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া, কারো কিছু বলার নেই! ফল বিক্রেতার দীর্ঘ সময় ফল তাজা রাখার জন্য কেমিক্যাল প্রয়োগ করে, মাছ বিক্রেতা তার মাঝে ফরমালিন প্রয়োগ করে আজীবন মাছ তাজা রাখার জন্য যা কিডনি ধ্বংস করার জন্য শ্রেষ্ঠ উপাদান! কিন্তু প্রতিকার বিহীন এ অপরাধ বছরের পর বছর অবাধে চলছে, কোনো তদন্ত কিংবা কোনো মনিটরিং ছাড়াই। গবাদি পশু জবাই করার সময় কসাইখানায় যে সরকারি দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা তদারকি করার কথা, তাদের কাউকেও সেখানে কস্মিনকালেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিস্তারিত বিবরণ পেশ করে, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মন ভারাক্রান্ত করতে গেলে মনে হয়, ওদের পিঠখানা শক্ত কুলো হয়ে গেছে, ওদের কানে তুলো দিয়ে রেখেছে। কথায় বলে না… ‘বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো, মারো আর ধরো, পিঠ করেছি কুলো!’ সেইজন্য বলছিলাম, আমরা প্রতিনিয়ত নিরীহ নাগরিক হিসেবে, জেনে শুনে, বিষ পান করছি। আপনি, আমি, তিনি, উনি আমরা সকলেই। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেন দিন দিন কুম্ভঘুমে অজ্ঞান। তাই গ্রামাঞ্চলে কর্মরত থানা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের কাজে লাগালে হয়তো পজিটিভ ফল পাওয়া যেত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও অপ্রিয় সত্য, তারা খাবার দোকান মুদি দোকান হোটেল রেস্তোরাঁ মিষ্টির দোকান গুলোতে শুধু তদন্ত ছাড়াই লাইসেন্স দিয়েই খালাস! মাস শেষ নগদ মাসোহারা পেয়ে ওই পদের কর্মকর্তারা দিব্যি ফুলে ফেঁপে উঠছেন দিনকে দিন! অন্যদিকে সচিবালয় থেকে পতিতালয় পর্যন্ত বিভিন্ন রোগ আধি-ব্যাধি আক্রান্ত মানুষগুলো ঔষধ পথ্যের পেছনে অর্থ ব্যায় করতে করতে দিশেহারা! আবার ঔষধ পত্রেও নানা রকম ভেজাল দশা দুই নম্বরি কারবার! তাই কথায় বলে, কুইনাইনে জ¦র সারায়, কিন্তু কুইনাইনকে সারাবে কে ?
লেখক : শিক্ষক, কবি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
খুলনা গেজেট/এনএম

