১৯৯২ সাল। আমি তখন জাতিসংঘ শান্তি মিশন কম্বোডিয়ায় কর্মরত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী নানান শাখায় কাজ করতে হতো, তাই মাঝে মাঝে সকল শাখায় কর্মরত শান্তিরক্ষীদের নিয়ে সমন্বয় সভা বসতো। একদিন সমন্বয় সভায় অনেকেই বললেন- জাতিসংঘ আমাদেরকে প্রচুর ডলার খরচ করে এখানে রেখেছে। অতএব আমাদের জীবনবাজি রেখে সর্বোচ্চ মেধা, দক্ষতা ও যার যার পেশাগত অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ করতে হবে।
কয়েকজন এভাবে কথা বলার পর, একজন জার্মান মহিলা রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘জাতিসংঘ আমাদের কচু করছে। প্রতিদিন উপসাগরীয় যুদ্ধে মানুষ মারতে যে ডলার খরচ করছে, আমাদের পিছনে একমাসেও সেই পরিমাণ ডলার খরচ করছে না।’ তখন ইরান ইরাক যুদ্ধে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করেছিল। তাঁর কথা শুনে উপস্থিত সকল সদস্য একপ্রকার নীরব হয়ে গেল। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রমাণ করে দিলেন, পৃথিবীতে মানুষ মারার জন্য যত টাকা খরচ করা হয়, মানুষ বাঁচানোর জন্য সেই তুলনায় অনেক কম টাকা খরচ করা হয়। তাহলে কি মানুষই পৃথিবীর বোঝা?
একবার ভেবে দেখুন- মানুষ মারতে ও মানুষকে ঘরছাড়া করতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানি লেগেই আছে। ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশীয় বিভিন্ন দেশে একদল অন্য দলকে, এক জাতি অন্য জাতিকে, এক দেশ অন্য দেশের মানুষকে হত্যা করতে অথবা উচ্ছেদ করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে এবং লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করছে।
অন্যদিকে পৃথিবীতে বাঘ, শকুন, সাপ, ব্যাঙ, পশুপাখি কমে যাচ্ছে বলে তাদের টিকিয়ে রাখতে প্রচুর টাকা খরচ করছে। আমি জানি- সকল প্রাণী বাঁচিয়ে রাখা পৃথিবীর জন্য অতি জরুরি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো; মানুষ মারার নেশায় কেন মানুষই মরিয়া হয়ে থাকবে? তাহলে, মানুষ কি পৃথিবীর জন্য বোঝা হয়ে উঠছে? পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন কি কমে যাচ্ছে?
মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বুদ্ধি, বিবেক ও সৃজনশীলতার কারণে সে পৃথিবীকে করেছে সভ্য ও উন্নত। কিন্তু এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মানুষ এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে তারই কর্মকা- পৃথিবীর ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে- মানুষ কি নিজেই পৃথিবীর জন্য এক বোঝা হয়ে উঠছে?
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সম্পদের চাপ :
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৮ কোটি মানুষ পৃথিবীতে যুক্ত হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। কৃষিজমি, পানির উৎস, জ্বালানি সবকিছুই মানুষের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপচয়ের কারণে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১২০০ জনের বেশি মানুষ বসবাস করে, যা ভূমি ও পরিবেশের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন :
মানব সভ্যতার অগ্রগতি যেমন শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, তেমনি এর ফলেই তৈরি হয়েছে বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ু দূষণে মারা যায় (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, WHO)।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে-ফলস্বরূপ বরফ গলছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং ঝড়-বন্যা-খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বেড়ে যাচ্ছে। এসব কিছুর মূল কারণ মানুষ নিজেই।
বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি :
বিশ্ব বন্যপ্রাণী সংস্থার (WHO) এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বন্যপ্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৬৯% হ্রাস পেয়েছে। বন উজাড়, দখল, শিকার ও দূষণের ফলে প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। মানুষ তার বসতি ও শিল্প প্রসারে প্রকৃতিকে গ্রাস করছে।
নৈতিক ও মানবিক সংকট :
মানুষ শুধু প্রকৃতির উপর নয়, নিজ সমাজের প্রতিও বোঝা হয়ে উঠছে। লোভ, স্বার্থপরতা, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সাইবার অপরাধ, মাদক ও সহিংসতা এসবই মানুষের সৃষ্টি। জাতিসংঘ জানায়, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত, যার বড় অংশ যুদ্ধ ও সহিংসতার কারণে।
প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব :
যেখানে মানুষ প্রযুক্তি তৈরি করেছে নিজের সহায়তায়, এখন সেই প্রযুক্তিই তার কর্মসংস্থান কেড়ে নিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) অনেক খাতে মানুষের বিকল্প হয়ে উঠছে। মানুষ তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে যা এক নতুন ধরনের ‘মানব সংকট’ তৈরি করছে।
মানুষ পৃথিবীতে বোঝা হয়ে উঠছে এই বক্তব্য পুরোপুরি নেতিবাচক মনে হলেও বাস্তবের একটি অংশ এতে প্রতিফলিত। মানুষই পৃথিবী ধ্বংস করছে, আবার মানুষই পারে এই ধ্বংস থেকে উদ্ধার করছে। যদি মানবজাতি সচেতনভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, নৈতিকতা ও পরিবেশ-সচেতন জীবনযাপন গ্রহণ করে তাহলে পৃথিবী আবারও হতে পারে মানুষের জন্য আশীর্বাদ।
তবে যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে মানুষ সত্যিই পৃথিবীর কাঁধে এক অতি ভারী ‘বোঝা’ হয়ে উঠবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও সোনামুখ স্মার্ট একাডেমি এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/এনএম

