বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

ফ্লোটিলা, ফিলিস্তিন, শহীদুল আলম ও বিশ্ব মানবতা

এ এম কামরুল ইসলাম

বাংলাদেশের খ্যাতিমান মানুষ ড. শহীদুল আলমের নাম সবার জানা। তাঁর নামের সাথে অসংখ্য বিশেষণ যোগ করলেও পুরাপুরি বলা হবে না। আমি তাঁর সম্পর্কে জানতাম এরশাদ সরকারের আমল থেকে। বিশেষ করে এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলনের সময় তাঁকে জানতাম গোয়েন্দা নজরদারির কারণে। তখন আমি ছিলাম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরে।

সেই থেকে যত সরকার এসেছে সব সরকার তাঁকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রেখেছিল এবং জেল খাটিয়ে, জুলুম করে নানাভাবে নির্যাতন করেছে। কিন্তু তিনি তাঁর নীতি থেকে একচুলও নড়েননি।

আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ড. শহীদুল আলমের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। আমার চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা শুনতে তিনি ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং আমার চাকরি জীবনের উপর একটি ভিডিও ধারণ করার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমি বিভিন্ন কারণে ভিডিও ধারণ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করি। তবে মাঝে মাঝে তাঁর প্রকাশিত ‘দৃক নিউজ’ এ লিখেছি।

তিনি আমাকে একবার গোপনে জানালেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র ধারণ করতে সেখানে যাবেন। একথা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠেছিল। কিন্তু তিনি ঠিকই সেখানে গিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ে খাদ্য সহায়তা নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। সারা বিশ্বের মানবিক মানুষের সাথে একত্রিত হয়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে মানবিক কর্মকা-ে লিপ্ত আছেন। আমি তাঁকে কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করেও কথা বলতে পারিনি। তাই বিবেকের তাড়নায় এখানে তাঁর সম্পর্কে কিছু অসম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’

শহিদুল আলম (Shahidul Alam) বাংলাদেশের একজন প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রশিল্পী, কার্যকর সমাজকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক। যিনি ‘দৃক’ (Drik) গ্যালারী/ফটো-এজেন্সি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আলোকচিত্র ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

শহিদুল আলম ১৯৫৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী আবুল মনসুর ও মাতা কাজী আনোয়ারা মনসুর। প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন শেষে তিনি উচ্চ শিক্ষা নিতে যান যুক্তরাজ্যে।

তিনি University of Liverpool থেকে BSC (রসায়ন) নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যয়ন করেন এবং পরে University of London/Royal Holloway–G PHD in organic chemistry অর্জন করেন। তবে তাঁর মূল আকর্ষণ ছিল আলোকচিত্র ও মিডিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন।

‘দৃক’ (Drik) গ্যালারী ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণ

Drik Picture Library (বাংলায় ‘দৃক’) ১৯৮৯ সালে শহিদুল আলম ও রেহনুমা আহমেদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘দৃক’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ‘দৃষ্টি’ বা ‘ভিশন’।

Drik-এর উদ্দেশ্য ছিল, আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও আলোকচিত্র ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বের (বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার) আলোকচিত্রীদের কাজকে সামনে আনা এবং বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করা।

Drik শুধুই একটি গ্যালারি নয়—এটি একটি সমন্বিত মিডিয়া ও আলোকচিত্র সংস্থা। যেখানে ছবির প্রকাশ, মিডিয়া প্রযুক্তি, প্রদর্শনী, শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি অনেক বিভাগ কাজ করে।

Drik-এর মধ্য দিয়ে শহিদুল আলম বাংলাদেশের প্রথম ইমেইল নেটওয়ার্ক চালু করেন এবং বাংলা ফন্ট ডিজাইন, অনলাইন ম্যাগাজিন (ওয়েবজিন) প্রভৃতি উদ্যোগ প্রহণ করেন—যা মূলত তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ‘ভাষাগত বৈষম্য’ (digital divide) কমাতে সহায়ক হয়েছে। যারা এখনও দৃক ভবনে যান নি তারা সুযোগ পেলে ঢাকার পান্থপথে দৃষ্টিনন্দন ভবনটি দেখতে ভুল করবেন না।

অন্যান্য উদ্যোগ ও প্রভাব

শহিদুল আলম শুধু “দৃক” প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি একাধিক নতুন উদ্যোগ ও প্রকল্প চালু করেছেন। Pathshala South Asian Media Institute (1998) একটি উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে আলোকচিত্র ও মিডিয়া শিক্ষার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। Chobi Mela (আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব)—১৯৯৯ সালে শুরু করা হয়, এশিয়ার একজন উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্র উৎসব হিসেবে পরিচিত।

Majority World—২০০৪ সালে এই উদ্যোগ শুরু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নশীল দেশের আলোকচিত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করা ও ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা। তাঁর ছবিগুলি বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও জাদুঘরে দেখানো হয়েছে—যেমন MoMA, Tate Modern, Centre Pompido ইত্যাদি।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বলিষ্ঠতা, চ্যালেঞ্জ ও স্পর্শ

শহিদুল আলম তাঁর কাজকে ক্ষমতার চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক ন্যায়বিচার আলোচনায় নিয়োজিত করেছেন। ২০১০ সালে তাঁর ‘Crossfire’ নামে এক প্রদর্শনী বিতর্কের মুখে পড়ে। আলোচ্য বিষয় ছিল অবৈধ নিহত (extrajudicial killings) ঘটনা। তাঁর এই কর্মসূচীর আগে পুলিশ প্রদর্শনীর গ্যালারিতে বাধা দেয়, তবে আদালতে আইনি চাপে গ্যালারি খুলতে অগ্রগতি হয়।

২০১৮ সালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন প্রসঙ্গে সরকারকে সমালোচনা করে তিনি অনেক বিতর্ক ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়েন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন যেমন- Time Magazine Person of the Year 2018, Lucie Awards, Honorary Fellowship of the Royal Photographic Society সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের একুশে পদক লাভ করেন।

ফ্লোটিলা ও শহীদুল আলম

বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ফিলিস্তিন আজও এক অনন্ত বেদনার নাম। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান দমননীতি, দখলদারিত্ব ও অবরোধের ফলে ফিলিন্তিনি জনগণ আজ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। গাজার শিশু, নারী ও বৃদ্ধ সকলেই অমানবিক জীবনযাপন করছে। এই অমানবিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেকের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছিল এক অনন্য উদ্যোগ।

ফ্লোটিলা কী ও কেন

‘ফ্লোটিলা’ (Flotilla) শব্দের অর্থ ছোট-বড় একাধিক নৌযানের দল, যা সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে, বিশেষত মানবিক সহায়তা বা প্রতিবাদের বার্তা নিয়ে যাত্রা করে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ আরোপের পর খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের এই নগ্ন লঙ্ঘনের প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী ও দাতব্য সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেয় যার নাম দেওয়া হয় ‘গাজা ফ্লোটিলা’।

২০১০ সালের ঐতিহাসিক গাজা ফ্লোটিলা

২০১০ সালের মে মাসে নয়টি জাহাজে করে প্রায় ১০,০০০ টন খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী ও নির্মাণ সরঞ্জাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাবাহী বহর। তুরস্ক, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সুইডেনসহ বহু দেশের নাগরিক এতে অংশ নেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশ করার পর ইসরায়েলি নৌবাহিনী জোরপূর্বক ফ্লোটিলাটির ওপর হামলা চালায়।

তুরস্কের ‘মাভি মারমারা’ নামের জাহাজে চালানো ওই হামলায় নয়জন মানবাধিকারকর্মী নিহত ও বহু মানুষ আহত হন। এই নির্মম ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। জাতিসংঘ তদন্ত কমিটি পরবর্তীতে জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে।

মানবতার বার্তা ও প্রতিরোধের প্রতীক

ফ্লোটিলা অভিযান শুধু একটি সাহায্য পাঠানো কর্মসূচি ছিল না এটি ছিল অবরোধ ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক নৈতিক প্রতিরোধ। এতে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রের মানুষ, তাদের একমাত্র পরিচয় তারা মানবতার পক্ষে। এই অভিযান বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, দমন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরব থাকা মানেই অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব জনমতের ভূমিকা

বাংলাদেশ শুরু থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ফিলিস্তিনে সহায়তা পাঠানো, আর্থিক অনুদান ও মানবিক প্রচারণা চালানো হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আজও ফ্লোটিলা অভিযানের স্মৃতি ধরে রেখে গাজা অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। পরবর্তীকালে Freedom Flotilla Coalition নামে আন্তর্জাতিক জোট গঠিত হয়, যা এখনও ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ মানবিক সহায়তা পাঠানোর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

চলমান ফ্লোটিলা নিয়ে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ চরম উৎকন্ঠার মধ্যে আছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, নিউজ চ্যানেল ও শহীদুল আলমের নিজস্ব ফেসবুক পেইজ থেকে পাওয়া তথ্যমতে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭০ টি ছোট বড় জাহাজ খাদ্য ও সাহায্য সামগ্রী নিয়ে গাজায় পৌঁছে গেছে। কিছু কিছু জাহাজ ইসরায়েলের কাছে আটক ও হয়রানির শিকার হয়েছে। ড. শহীদুল আলম বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযানে শরীক হয়েছেন। কুখ্যাত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হাতে তাঁরা নিগৃহীত হচ্ছেন। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাঁদের জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁদের হেফাজত করুক।

ফিলিস্তিনে মানবিক সাহায্য নিয়ে ফ্লোটিলা অভিযান বিশ্ব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ফ্লোটিলা এটি প্রমাণ করেছেন মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য অস্ত্র নয়, প্রয়োজন সাহস, ন্যায়ের বিশ্বাস ও সহমর্মিতার চেতনা। গাজার রক্তাক্ত মাটিতে এই অভিযানের বার্তা আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘মানবতা কোনো সীমান্ত মানে না।’

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও সোনামুখ স্মার্ট একাডেমি ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন