ইসলামী আধ্যাত্মিক নেতা, সাধক, মানবহিতৈষী সমাজ সংস্কারক হযরত খান জাহান আলীর (রহঃ) স্মৃতি বিজড়িত এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণ বাংলার পুণ্যভূমি খুলনায় যে সকল ক্ষণজন্মা মানুষ জন্ম লাভ করে খুলনার মাটিকে ধন্য করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, অসাধারণ বাগ্মী, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, সমাজসেবাব্রতী, খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ আব্দুস সবুর খান। বৃহত্তর খুলনা জেলার তৎকালীন বাগেরহাট মহাকুমার ফকিরহাট থানার বাহিরদিয়া-মানসা ইউনিয়নের আটটাকা গ্রামের অতি সাধারণ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে তিনি তাঁর স্বীয় প্রতিভা বলেই সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে অতি সংক্ষেপে জীবন কথার কিছুটা আলোকপাত করব।
সবুর খানের পিতা নাজমুল হোসেন খান ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী আর তাঁর মমতাময়ী মা সবুরন্নেছা ছিলেন গৃহিনী। শিক্ষা জীবনের শুরুতে তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে খুলনা জিলা স্কুলে লেখাপড়া আরম্ভ করেন এবং সেখান থেকেই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪টি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং সেখান থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা সিটি কলেজ হতে তিনি বিএ ডিগ্রী অর্জন করে আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্যে ইউনিভাসিটি ল’ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তখনতো প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশের গোলামীর নাগপাশ হতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এমতবস্থায় একজন মেধাবী, সমাজ সচেতন, হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্খা লালনকারী সাহসী যুবক কিভাবে নিস্ক্রিয় থাকতে পারে? তাছাড়া সেই সময়ে পরাধীন ভারতের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বিশেষ করে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় যাঁরা কাজ করছিলেন সেই নেতাদের অন্যতম প্রথিতযশা ব্যারিষ্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কিছুটা সানিধ্য তিনি লাভ করেছিলেন।
জানা যায়, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পরামর্শে তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যোগদান করতে আগ্রহী হন এবং তারুণ্যে ভারপুর ২৪/২৫ বছরের যুবক সবুর খান তখন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক শ্রমিক দলে যোগদানের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে তাঁর অভিষেক হলেও ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আমন্ত্রণে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা, দুরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণাবলী সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাইতো যুবক বয়সে তিনি জনপ্রিয় নেতা হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে খুলনা গান্ধী পার্কে (বর্তমান হাদিস পার্ক) তিনদিন ব্যাপী তৎকালীন হিন্দু মহাসভার এক সম্মেলনে কলকাতা হতে আগত অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি বিনায়ক দামোদর সাভারকারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতেই কংগ্রেস নেতা নগেন্দ্রনাথ সেনের কন্যা ভবানী সেন মুসলিম সমাজের প্রতি কটাক্ষ করে যে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করেন তাতে মুসলমানগণ ভীষণভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত হয়। তখন খুলনা শহরসহ খুলনা বিভিন্ন অঞ্চলে এক চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে মুসলমানদের দুর্দিনে উদ্ভুত নাজুক পরিস্থিতিতে জননেতা সবুর খান মুসলিম সমাজকে সংগঠিত করে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঐ কটুক্তির প্রতিবাদে খুলনায় সর্বপ্রথম মুসলমানদের স্বাধীকার আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্ব দান করেন এবং গান্ধী পার্কে সভা করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঐ সভাটিই ছিল খুলনা শহরে মুসলমানদের প্রথম সভা। এর ফলে খুলনার রাজনীতিতে নেতা হিসেবে আব্দুস সবুর খানের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ক্রমশই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেন।
তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে খুলনা সদর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৪ আগস্ট দেশ স্বাধীন হল। ব্রিটিশ বিদায় নিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভোটে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও ১৪ আগস্ট কিন্তু খুলনায় পাকিস্তানের পতাকা উড়েনি। সেদিন উড়েছিল ভারতীয় পতাকা। তবে এই অবস্থার মধ্যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও মুসলমান আইনজীবীগণ খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরে বাউন্ডারী কমিশনে আপিল করেন। আইনজীবী হামিদুল হক চৌধুরী, শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মোহাম্মদ ওয়াসিম খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে শুনানীতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ১৭ আগস্ট ঘোষণা করা হয় খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আর মুর্শিদাবাদ ভারতের অংশে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের সময় খুলনা প্রেসিডেন্সী বিভাগে ছিল বলে তখন খুলনা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। আবার খুলনার জনসংখ্যার ৫১% ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা খুব সহজ ছিল না। তবে এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী মনেপ্রাণে চেয়েছিল খুলনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হোক।
খুলনাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় অবিভক্ত বাংলার শেষ বঙ্গীয় আইন সভার খুলনার সদর আসনে সদস্য খুলনার সুযোগ্য নেতা আব্দুস সবুর খান মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে এক মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ছিল বলে তিনি প্রকাশ্যে কোন কাজ করতে না পারায় তাঁর ভূমিকা হয়তো দৃশ্যমান ছিলনা। কিন্তু নেপথ্যে তাঁর বলিষ্ঠ ভুমিকা থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছিল খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা। গ্রেপ্তারী পরোয়ানার জন্য বিপদের আশংকা থাকা সত্ত্বেও তিনি তা উপেক্ষা করে গোপনে খুলনা ত্যাগ করে কলকাতা যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মায়ের দোয়া নেওয়ার সময় বলেছিলেন ‘যদি খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি তবেই তোমার কোলে ফিরব’। মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তিনি বাউন্ডারী কমিশনে আপিলের সকল ব্যবস্থা করে খুলনাকে পাকিস্তানভুক্ত করেন। এই প্রক্রিয়া খুলনার যে সকল নেতৃবৃন্দ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে এ্যাডভোকেট এস এম এ মজিদ ও এ্যাডভোকেট এ এফ এম আব্দুল জলীল অন্যতম।
আব্দুস সবুর খান শৈশব থেকে ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী ছাত্র, আবার তেমনি ছিলেন ক্রীড়া অঙ্গনের উজ্জল নক্ষত্র। অর্থাৎ ক্রীড়াবিদ হিসাবে ফুটবল, টেনিস, ভলিবল ইত্যাদি খেলার মাঠে যেমন তাঁকে ভাল খেলোয়াড় হিসেবে দেখা গেছে তেমনি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও ক্রীড়ার উন্নয়নে তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
সবুর খান-এর জীবনের আর একটি উজ্জলতর দিক ছিল সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর প্রশংসনীয় পদচারণা। তিনি যেমন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন তেমনি নাট্য মঞ্চে তাঁর হৃদয়স্পর্শী অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করত। তিনি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
খুলনার নাট্য চর্চার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী নাট্য নিকেতনের যে গৌরবময় ভূমিকা ছিল তার পেছনেও তাঁর অনেক অবদান ছিল। ১৯৫৩ হতে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি খুলনা নাট্য নিকেতনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতায় থাকাকালে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি সময় পেলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাহিত্যের আড্ডায় অংশ গ্রহণ করতেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে যখন ঢাকায় নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি একজন প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সবুর খান ছিলেন বই প্রেমিক মানুষ। নিজস্ব সংগ্রহে তার প্রচুর মূল্যবান গ্রন্থ ছিল। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানের খুলনা শহরের তাঁর বাড়ীতে আগুন লাগানোর ফলে বাড়ীর বিভিন্ন মালামাল আসবাবপত্র ইত্যাদির সঙ্গে অনেক দুর্লভ বই পুড়ে যাওয়ায় দুঃখ করে বলেছিলেন আমার বাড়ীতে আগুন লাগানোর ফলে অনেক মূল্যবান জিনিস ভস্মীভূত হওয়ায় আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমি সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছি আমার সংগ্রহের বইগুলি পুড়ে যাওয়ায়। কেননা ঐ সমস্ত দুর্লভ বই আমি আর পাব না। তিনি নিজে যেমন বই সংগ্রহ করতেন তেমনি খুলনার শতবর্ষী লাইব্রেরি উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। তিনি প্রতিদিন নিয়মিত বিভিন্ন সংবাদপত্র পড়তেন এবং তখনকার সময়ের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডিও সংবাদ শ্রবন করতেন। তিনি বলতেন রাজনীতি করতে হলে দেশ বিদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ও সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, মানুষের সুখ-দুঃখের কথা জানতে হবে। সেজন্য অবশ্যই পড়াশুনা করতে হবে।
অনন্যসাধারণ বাগ্ম হিসেবে তিনি বাংলা, ইংরেজী ও উর্দু ভাষায় অতি চমৎকার ছন্দময় বক্তৃতা করতেন। বক্তৃতায় তাঁর বাচন ভঙ্গি, শব্দ চয়ন, কন্ঠস্বর ও প্রাসঙ্গিক উপস্থাপনা ছিল অতুলনীয়। তিনি যেমন জনসভাতে ভাষণ দিলে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনত, তেমনি তিনি ছিলেন দক্ষ, বিজ্ঞ ও হৃদয়স্পর্শী পার্লামেন্টরিয়ান। আবার টেবিল টকে তিনি অসাধারণ যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার দ্বারা প্রতিপক্ষকে স্তম্ভিত করে দিতেন।
আব্দুস সবুর খান ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লি নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে খুলনা-২ আসনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিষয়ে অবহিত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। ঐ সময়ে তিনি পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলি নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য তখন পাকিস্তানের সরকার পদ্ধতি যদি প্রেসিডেন্টসিয়াল সরকার পদ্ধতি না হয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হত তাহলে পাকিস্তান ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লির নেতা হিসেবে তিনিই তখন হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইযুব খানের শাসনামলের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৬৯ এর মার্চ পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী ও ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লির নেতার দায়িত্ব পালন করেন। সবুর খান মন্ত্রী থাকালীন সময়ে তাঁর প্রচেষ্টায় খুলনা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরি (বয়রা), খুলনা ক্যাবল শিল্প কারখানা (শিরোমনি), খুলনা পোস্ট মাস্টার জেনারেল অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং খালিশপুরে শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন করেন।
আদর্শগতভাবে তিনি পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে ছিলেন সত্য কিন্তু সেজন্য তিনি কোন ধরনের হত্যা, লুন্ঠন ইত্যাদি অমানবিক, হিংসাত্মক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বরং তিনি বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের যথাসাধ্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা জানি তাঁর বিরুদ্ধে কোন ধরনের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছিল না। তিনি অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা থাকাকালে জননেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হয়ে কাজ করার সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কর্মী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যেমন সবুর খানকে তাঁর সহযোদ্ধা হিসাবে ভালবাসতেন, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্নেহ করতেন।
সঙ্গতকারণে সবুর খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে এই সম্পর্ক বজায় ছিল। মানুষের জীবন ধারায় সুসময় আর দুঃসময় দুইই থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের দুঃসময়ে সবুর খান তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে যেমন সহায়তা করেছেন তেমনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে সবুর খানের যাতে কোন ধরনের অসুবিধা না হয় সে বিষয়ে যত্নবান ছিলেন।
সবুর খান সত্যিকার অর্থে জনদরদী, দেশপ্রেমিক ও গণমানুষের নেতা ছিলেন। তা তিনি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে রাজনীতির মঞ্চে দাড়িয়ে প্রমাণ করে গেছেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে যখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনপ্রবর্তন করেন তখন তিনি সবুর খানের সহায়তা কামনা করেছিলেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দলে ও তাঁর সরকারে যোগদানের জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সবুর খান নেপথ্যে থেকে পরোক্ষভাবে জিয়াউর রহমানকে সহায়তা করেছিলেন। যখন দেশের বাঘা বাঘা নেতারা বঙ্গভবনের সিড়িতে পা রাখার জন্য রাষ্টপতি জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন সবুর খান বঙ্গভবনের আমন্ত্রণ পেয়েও দৃঢ়প্রত্যয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বলেছিলেন, “আমি যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের হতভাগ্য দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের আদর্শ ধারণ করে মুসলিম লীগের পতাকা বহন করতে পারি।” তাইতো ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ মুসলিম লীগ পুনর্জীবিত করে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সেই মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় নির্বাচনে বৃহত্তর খুলনার : খুলনা-৬, খুলনা-৮ ও খুলনা-১৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রাক্কালে দেশের মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমি আমার জীবন সায়াহ্নে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি এইটুকু জানার জন্য যে, আমার জন্মভূমি এবং আমার দেশের মানুষের জন্য যা করেছি তা কি সঠিক ছিল? নাকি আমি ভুল করেছি? যেহেতু মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করতে হয় তাই জনগণ অর্থাৎ আপনারাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, আজ আমি বিচার প্রার্থী হয়ে আপনাদের রায় চাই। আপনারা যে রায় দেবেন তা আমি মাথা পেতে নেব।” বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ঐ নির্বাচনে গণমানুষের ঐতিহাসিক রায়ে প্রমাণিত হয় আব্দুস সবুর খানের রাজনীতি ছিল নির্ভুল। তাইতো তিনি ৩টি আসনেই মানুষের বিপুল সমর্থন পেয়ে জয়লাভ করেছিলেন, যা অতীতে কেউ কোন দিন অর্জন করতে পারেনি, আর ভবিষ্যতেও কেউ পারবে না। তাঁর এই বিস্মকর বিজয়ের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ও থাকবে। আবার তাঁর কল্যাণকর রাজনীতির কর্মকান্ডের দৃষ্টান্ত সকল রাজনীতিবিদদের জন্য শিক্ষনীয় ও অনুসরণীয় হয়ে রয়েছে এবং থাকবে। অর্থাৎ যারা রাজনীতি করেন এবং করবেন তাঁদের রাজনীতির দর্শন হতে হবে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আত্মউৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই তার রাজনীতির জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।
জননন্দিত নেতা খান-এ-সবুর জীবনের শেষ ক’টি দিন অসুস্থ হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজধানীর ব্যস্ততম ধানমন্ডি-মীরপুর সড়কের মানিক মিয়া এভিনিউ জংসনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ভবন, ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র এবং আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ধারক ও বাহক মহান জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ছিম-ছাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশে দেশের কয়েকজন মহান মানুষের সমাধি সৌধের মাঝে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই মহৎপ্রাণ আজন্ম ত্যাগী মানুষ আব্দুস সবুর খান, যার কাছে গিয়ে কেউ কোনদিন খালি হাতে ফেরেনি তিনি মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি জনসাধারণের কল্যাণ উৎসর্গ করে গেছেন। এর কার্যক্রম সুষ্ঠু পরিচালনার লক্ষ্যে খুলনা জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে শিক্ষা, ধর্ম ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য খান-এ-সবুর ট্রাস্ট গঠন করে গেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই খুলনার মাটির কৃতী সন্তান জননন্দিত নেতা আব্দুর সবুর খান ছিলেন এক দীপ্ত প্রদীপ, যিনি ছড়িয়েছেন উজ্জল আলো আর আলো। কিন্তু উজ্জল আলোকে ’ত সবাই সহ্য করতে পারে না, অন্ধকার কানাগলিতেই তাদের স্বস্তি। আমার প্রশ্ন- তা’হলে কিভাবে অন্ধকার কানাগলির মানুষগুলি ঐ দীপ্ত প্রদীপকে সহ্য করবে?
লেখক : প্রাক্তন ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও লেখক।
খুলনা গেজেট/এনএম

