মঙ্গলবার । ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২

শিক্ষার মান অর্জনে শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণ সময়ের দাবি

গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক

সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, শিক্ষকতা মহান পেশা, শিক্ষকেরা সমাজের সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার পাত্র। পিতা-মাতার পরের স্থান শিক্ষকের। কথা শতভাগ সত্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! এই পেশায় অন্তর্ভূক্ত হবার পর সিংহভাগ শিক্ষকের মতামত, কেন যে এমন পেশায় এলাম! সমাজের কেউই শিক্ষকদের দিকে নেক নজরে তাকায় না। সমাজে নেই কোন মর্যাদা। আর আর্থিক দিকে সবচেয়ে সুবিধা বঞ্ছিত এই শিক্ষক সমাজ। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এতে ইউনিসেফ এরও সমর্থন রয়েছে। এতদিন সাদামাঠাভাবে দিনটি পালিত হতো, কিন্তু সম্প্রতি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেওয়ায় আন্তরিক ধন্যবাদ।

সর্বমোট ২১টি দেশ ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস পালন করে: আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বুলগেরিয়া, কানাডা, এস্তোনিয়া, জার্মানি, লিথুনিয়া, মেসিডোনিয়া, মালদ্বীপ, মরিশাস, প্রজাতন্ত্র মোল্দাভিয়া, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কুয়েত, কাতার, রোমানিয়া, রাশিয়া, সার্বিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্য। ১১টি দেশ ২৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস পালন করে: মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, বাহরাইন, সুদান ও ওমান। ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তাহলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিনটি পালন করে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে ৩০মিলিয়ন শিক্ষক ও ৫০০টি সংগঠন শিক্ষকদের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করেছে। অন্য দেশের সাথে বাংলাদেশে ৫ অক্টোবর দিবসটি পালিত হবে।

শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International – EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, তবে শিক্ষকরা সে মেরুদন্ডের স্রষ্টা। গোটা মনুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটাও নাই। শিক্ষকই এ সমাজের প্রাণ । পৃথিবীতে যিনি যত মহান হোন না কেন, তিনি কোনো না কোনো শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেছেন।

তাই পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ শ্রেণির তারা সার্বিকভাবে না হলেও, ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে ঋণী। তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলে পাশের অধিক্য বাড়লেও গুনগত মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তাই মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষতা সম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে হবে। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International – EI) মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান হিসেবে নির্ধারণ করেছে: ১) মান সম্মত শিক্ষক ২) মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ ও ৩) মানসম্মত পরিবেশ ।

এ সকল প্রেক্ষাপটে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন আদর্শ মানুষ গড়তে আদর্শ শিক্ষকের কোন বিকল্প নেই। ইউনেস্কো-আইএলও যে সুপারিশ গ্রহণ করে তাতে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। এগুলো হলো শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্র প্রদান করবে শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা, সমাজ প্রদান করবে শিক্ষকের মর্যাদা, আর একজন শিক্ষকের কর্তব্য শিক্ষকই পালন করবেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ে শিখন শিখানো কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করবে। শ্রেণী কার্যক্রম ছাড়াও শিক্ষার্থী মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা কার্যক্রম, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আরো যুক্ত হবে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম পরিচালনা শিক্ষকের কর্তব্য। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুপস্থিত। শিক্ষা বেসরকারি পর্যায়ে থাকায় প্রকৃত অভিজ্ঞ শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। তাই প্রতি উপজেলার সদ্য জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারির দ্রুত নিয়োগদান করে শিক্ষক ঘাটতি পূরণসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

২০১৮ বিধিমালা সংশোধনপূর্বক যথাযথভাবে শিক্ষকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করি। এসব প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদে শিক্ষক ঘাটতি দূর করে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। শিক্ষা যেমন জাতির মেরুদণ্ড, ঠিক তেমনি আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষক মানেই একটি সম্মানিত শব্দ, জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার, সব মানবিক গুণের অধিকারী। আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু সুকৌশলে পাঠদানই করেন না, ছাত্রদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকেও জাগিয়ে তোলেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, আইনজীবী, আমলা, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, তথা আগামীর ভবিষ্যৎ। তিনি যেন প্রজন্ম গড়ার কারিগর। ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি গঠনেও শিক্ষক প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলছেন। তাই একটি জাতিকে আলোকিত ও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী করতে সুশীল শিক্ষক সমাজের কোনো বিকল্প নেই, শিক্ষকেরা আমাদের জাতীয় জীবনের আশীর্বাদস্বরূপ। যোগ্য শিক্ষকরাই প্রতিটি ছাত্রের মনে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, ধর্ষণের মতো অপরাধপ্রবণতার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে দেশপ্রেম, সততা, সময়ানুবর্তিতা জাগিয়ে তুলে একটি আদর্শ জাতি গঠন করতে পারেন। তাই জাতির প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধের জায়গাটাও অনেক বেশি।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষকেরা মোমবাতির মতো নিজে পুড়ে অন্যকে শিক্ষার আলো দান করেন। শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক করে তুলে মানুষের মধ্যে ঘুমন্ত মানবতাকে জাগ্রত করে। সমাজের মহাকাশের মাঝে নীহারিকা হয়ে অবস্থান করছে শিক্ষকসমাজ। যে নীহারিকা জন্ম দেয় হাজার হাজার নক্ষত্ররাজি, শিক্ষকদের অনাদি আলোক রশ্মির উৎস থেকে জন্ম হয় আগামীর সমাজ সচলতার এককগুলো। যাদের সমাহারে তৈরি হয় গোটা সমাজ, গোটা বিশ্ব। বিশ্ব শিক্ষক দিবস শুধুমাত্র শিক্ষকদের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণের কথাই বলেনা, বরং আগামি প্রজন্মের মানসম্মত শিক্ষার কথা চিন্তা করে শিক্ষকতা পেশাকে আরো আকর্ষণীয় এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের কথাও বলে। The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage অর্থাৎ কাক্সিক্ষত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণে বৈশ্বিক অপরিহার্যতা রয়েছে। বিধায়, কাঙ্খিত শিক্ষার মান অর্জনে শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ এবং শিক্ষকের মূল্যায়ন সময়ের দাবি, তবেই দেশ পাবে শিক্ষিত, স্মার্ট ও দক্ষ নাগরিক।

লেখক : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন