বুধবার সকাল, খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডের স্বনামধন্য সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে আয়েশা মিস রোলকল করছেন। এক, দুই, তিন, তিন, রোল তিন…..। তিন রোল রাহিম ক্লাসে আসতে পারেনি।
খোঁজ নিলে তার মা জানান, রাহিম তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। প্রথমে তারা ভেবেছিল সাধারণ সর্দি-জ্বর, কিন্তু ধীরে ধীরে জ্বর বেড়ে গেল, পেটব্যথা শুরু হলো, ক্ষুধা কমে গেল। চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পর জানা গেল রাহিম টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত। রাহিমের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, স্কুলগামী শিশুরা প্রতিদিন ক্যান্টিন বা রাস্তার পাশের খাবার খাওয়ার মাধ্যমে কতটা ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে টাইফয়েড, ডায়রিয়া বা জন্ডিসের মতো পানিবাহিত রোগ, যা দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
টাইফয়েড জ্বর মারাত্মক সংক্রমণজনিত রোগের মধ্যে অন্যতম, যা সালমোনেলা টাইফি (S.Typhi) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি রক্তপ্রবাহে এবং অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া বহন করে। সাধারণত দূষিত পানি, অপরিষ্কার খাবার এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই জীবাণু ছড়ায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে ৫ থেকে শুরু করে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এর সংক্রমণ সর্বোচ্চ। কারণ তারা খাবারের বিষয়ে সচেতন থাকে না। প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে বাইরে থেকে নানা খাবার খাওয়া, হাত না ধোয়া, দূষিত পানি পান করা বাচ্চাদের নিত্যদিনের ব্যাপার। এছাড়া ছোটদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বড়দের তুলনায় কম। রাহিমের মতো আরও অনেক বাচ্চা প্রতি বছর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। ঘনবসতিপূর্ণ বা বস্তি এলাকা, রোগ প্রাদুর্ভাব হয়েছে এমন এলাকা অথবা নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে এমন এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে সাধারণত সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার বেশি।
গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ ৭৮ হাজার জন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং ৮ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে ৬৮ শতাংশই শিশু। এ রোগের প্রধান উপসর্গগুলো হলো দীর্ঘমেয়াদি জ্বর (৩৭ দিন বা তারও বেশি ১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), দুর্বলতা ও ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, পেটব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, অনেক সময় শরীরে লালচে ফুসকুড়ি থাকতে পারে। যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, টাইফয়েড শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং জটিলতায় রূপ নিতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। টাইফয়েড হলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি, বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো শনাক্তকরণ। দেরি হলে জটিলতা বাড়তে পারে। অনেক সময় রক্ত পরীক্ষা বা ‘Widal Test’ করে রোগ নিশ্চিত করা হয়। তবে টাইফয়েড প্রতিরোধ করা সম্ভব কিছু নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে। প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা গ্রহণ। টাইফয়েড প্রতিরোধে বর্তমানে কার্যকর টিকা রয়েছে। স্কুলগামী শিশুদের এ টিকা দেওয়া উচিত।
টাইফয়েড জ্বর থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে সরকারের ইপিআই কর্মসূচির আওতায় আগামী ১২ অক্টোবর ২০২৫ থেকে টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। টিসিভি বা টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন, একটি নিরাপদ, কার্যকর এবং নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা সুপারিশকৃত টিকা, যা টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বল্প খরচ ও সমন্বিত পদ্ধতির অংশ হিসেবে নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির সাথে যুক্ত। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী অর্থাৎ সকল বিভাগের সকল জেলা, উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভায় ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে একই সাথে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশুকে এক ডোজ টিসিভি টিকা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি পর্যায়ে এক লাখ ৭৩ হাজার শিশুকে টাইফয়েড টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্দিষ্ট সকল শিক্ষার্থী এবং শিশুদের https://vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে জন্ম নিবন্ধন সনদের ১৭ সংখ্যা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পরবর্তীতে ঐ একই ওয়েবসাইট থেকে টাইফয়েড টিকাদান কার্ড ডাউনলোড করে টিকাদানের দিন নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। যে সকল শিক্ষার্থী ৮ম/৯ম শ্রেণিতে পড়ে কিন্তু বয়স ১৫ বছরের বেশি, তাদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাস্থ্য সহকারী/টিকাদানকর্মীর সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। যদি কোনো শিশু টিকা গ্রহণের দিন অসুস্থ থাকে, জ্বর (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি), কিংবা পূর্বে কোন টিকা দেওয়ার পর এলার্জির ইতিহাস থেকে থাকে তাহলে তাদের টিকা গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। একই সাথে বলা হয়েছে গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী মায়েরা টিকা গ্রহণ করলে বাচ্চা ও মায়ের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ইসলামী শরীয়তের হুকুম হলো মহান আল্লাহ তা’য়ালাই রোগ দিয়েছেন এবং তিনিই সুস্থ করবেন। এ আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে কেউ যদি পথ্য বা ওষুধ গ্রহণ করে, তবে এটাই আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত।
তিনি বলেছেন, “তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর, কেননা আল্লাহ তা’য়ালা যত রোগ দিয়েছেন, তার সবগুলোর জন্য আরোগ্যের ব্যবস্থা করেছেন, তবে মৃত্যু ও বার্ধক্য ব্যতীত (আহমাদ ও ইবনে হিব্বান)।” যেহেতু মুসলিমদের জন্য হালাল উপায়ে রোগ নিরাময় করা ধর্মীয় অনুশাসনের অংশ সেহেতু এখানে জেনে রাখা ভালো যে, ভারতের নয়া দিল্লীর জামিয়াত উলামা-ই-হিন্দ হালাল ট্রাস্ট এর হালাল সনদ প্রাপ্ত এগারোটি টিকা রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশে সরবরাহকৃত টিসিভি বা টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (মনোভ্যালেন্ট) একটি।
রাহিমের ঘটনা একটি উদাহরণমাত্র। রাহিম ভাগ্যবান ছিল, কারণ তাকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণে শিশুদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তাই সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি ও টিকা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সহজেই এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। প্রতিটি অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের দায়িত্ব হলো শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখা।
লেখক : তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম
								
    
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
