বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২

সুরের আকাশে অবিস্মরণীয় তারকা

আবদুল কাদের খান

অনেকদিন ধরে ভেবেছি, ধানের দেশ, গানের দেশ, নদীর দেশ- আমার প্রিয় বাংলাদেশ এবং তার সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়ে কিছু লিখবো। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের’ মতো গত ১৩ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত দশটা পনেরো মিনিটে জানলাম, লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন আর নেই ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব)। নিজেও চলে গেলেন অচিন দেশে অর্থাৎ না ফেরার দেশে।

‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ প্রায় ছয় দশক ধরে লালন সাঁইয়ের এই গান যাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, অসংখ্য মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে, যিনি হয়ে উঠেছিলেন লালন গানের সমার্থক, প্রধান প্রবক্তা, মরমি শিল্পী, সেই সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন আর এহ জগতে নাই। কথাটা ভাবতে মনের ভিতর কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে যায়!

লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী, লক্ষ-কোটি মানুষের মন জয় করা, সকল সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে ঝড় তোলা, সেই ফরিদা পারভীন আলো ছায়াময় পৃথিবীর এ অঙ্গন থেকে বিশাল নক্ষত্র পতনের মত ঝরে পড়লেন। ‘যম আর জীবনের’ সাথে বেশ কিছুদিন লড়াই চলছিল। কিন্তু শেষে তিনি হার মানলেন, অমোঘ মৃত্যুর কাছে। চলে গেলেন চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে।

জননন্দিত প্রখ্যাত লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিনের পরপারে পাড়ি দেওয়ায় শোক সাগরে ভাসছেন, তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্ত কুল, শুভানুধ্যায়ী, সহশিল্পী সতীর্থরা। আবার আরেকবার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এমন বিশুদ্ধ শিল্পীর বিদায়ে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসলো।

পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলিম, জয়নুল আবেদিন এরা মোটা দাগের লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা বরেণ্য শিল্পী ছিলেন। এই দেশ যাদের নামে পরিচিত ও ধন্য। এই দেশ যাঁদের নিয়ে আজও গর্ব করে। বাংলাদেশ চিরকাল এ অমর প্রথিতযশা শিল্পীদের শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করবে।

প্রথমেই বলেছি, জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী। এরই পাড়ে পাড়ে জন্মেছেন এসব কৃতি সন্তানেরা। যদিও ধান গান নদী মিলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের শস্য শ্যামলা জমিন আবাদ করে যে কৃষক, তার আনন্দের খোরাক যোগায় গান। সেই গানের রূপকার ছিলেন আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলিম, ফরিদা পারভীন। এখনো কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে বেঁচে আছেন ফেরদৌসী রহমান। তারই সহোদর, মোস্তফা জামান আব্বাসী এই কিছুদিন আগে চলে গেলেন।

আব্বাস উদ্দিনের গানে, উত্তরবঙ্গের কৃষিজীবী সহ সকল স্তরের মানুষের মন থাকতো পাগল পারা। তাঁর ভাওয়াইয়া গান যেকোনো সংগীতপ্রিয় মানুষকে আজও পাগল করে তোলে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ এ ধরনের উচ্চারণে।

ভাটিয়ালি গানের নন্দিত সম্রাট ছিলেন আব্দুল আলিম। তাঁর গান বাংলাদেশের ভাটির নদীতে নৌকা ছেড়ে দিয়ে মাঝি মাল্লারা আজও গলা ছেড়ে দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে চর্চা করে। আব্দুল আলীমের গানে দক্ষিণের ভাটি অঞ্চলের মানুষ তৃপ্তি খোঁজে জীবনের বাঁকে বাঁকে। সুরের এই অসামান্য সাধকদের কথা বাংলার মানুষের মনে চির অঙ্কিত হয়ে আছে। মরমি গীতিকার শিল্পী আব্দুল আলীমের আধ্যাত্মিক গানগুলোর মধ্যে, ‘দিবানিশি যে ছয় জনা দিত কুমন্ত্রণা, আজ তাহারা কোথায় গেল ভাবরে দেখি মনা!’
সত্যি কথা বলতে কি, মহিষের গাড়িটানা উত্তরবঙ্গের রুক্ষ মরুময় অঞ্চলে আব্বাস উদ্দিনের ভাওয়াইয়া গানের সুর লহরি আজও ওই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষকে বিনোদনের জগত আন্দোলিত করে। ঠিক তেমনি আব্দুল আলীমের গান পদ্মা পাড়ের মানুষের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ফরিদা পারভিন নাম বললেই কানে বাজে মোকসেদ আলি সাঁই, সিরাজ সাঁই, লালনের গান। যতদূর জানি, তাঁর দাদিও গান করতেন, বাবার ছিল গানের প্রতি অসম্ভব অনুরাগ। ১৯৬৮ সালের মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিশোরী ফরিদা পারভীন (জন্ম: ১৯৫৪) শুরু করেছিলেন, পেশাদার সংগীত জীবন। সেই থেকে শুরু আর ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার আনলাকি ১৩ সেপ্টেম্বর, তাঁর জীবনের তারা খসে যায়। নিভে গেল জীবন প্রদীপ। পুরো পঞ্চান্ন বছরের সংগীত জীবন। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় কাল তিনি আমাদের সঙ্গীত অঙ্গনের সবার মনে দাগ কেটেছেন।

ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলায় প্রায় সর্বক্ষণ মেতে থাকতেন। দাদা ও নানাবাড়ির মাঝখানে আত্রাই নদের শাখা নদী গুর খাল পার হয়ে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশের বিলে মামাতো ভাই বোনদের সাথে নিয়ে শাপলা তুলতে যেতেন।

পিতার চাকরি সূত্রে, ফরিদা পারভীনের শৈশব কেটেছে মাগুরায়। স্কুল জীবনের শুরুটাও সেখানে। ওই সময় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তাঁর সঙ্গীতে হাতে খড়ি। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে।

অনেক কাল লালনের দেশ কুষ্টিয়ায় ছিলেন ফরিদা পারভীন। কুষ্টিয়ার মীর মোশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং স্নাতক। ওই শহরেই তিনি দীর্ঘদিন চর্চা করেছেন লালন গীতির। পছন্দের শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হলেও ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীন নজরুল সংগীতের শিল্পী হিসেবে রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে তালিকাভুক্ত হন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লালন সংগীতের সঙ্গে তাঁর আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়। তখন তিনি কুষ্টিয়ায়। তখন তাঁর পিতার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকসেদ আলি সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভিন তাঁর কাছেই ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ গানটি শিখে লালন সাঁই এর গানের তালিম নেন। মোকসেদ আলী সাঁই এর মৃত্যুর পর খোদাবক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াসিন সাঁই ও করিম সাঁই এর কাছে তিনি লালন গীতি চর্চা করেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি আমৃত্যু মগ্ন ছিলেন লালন সংগীতে। দেশজোড়া খ্যাতির পাশাপাশি বহির্বিশ্বে এই শিল্পীর গাওয়া গানের গৌরব সৌরভ ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

বলাবাহুল্য, ফরিদা পারভীন সুইডেন সফরকালে সেখানে সে দেশের রানী তাঁর গান শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে ছিলেন, আর বলেছিলেন, “আমি তাঁর গানের কথাগুলো বুঝি না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে যে বেদনা আছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।”

সঙ্গীতজীবনে ফরিদা পারভিনের এরকম অজস্র স্মৃতিবহুল ঘটনা ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, “১৯৭৩ সাল বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউল শিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ড এর পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মোকসেদ আলি সাঁই। তৎকালীন ঢাকা বেতারের ট্রান্সক্রিপশন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ওস্তাদের আমন্ত্রণে ঢাকায় যাই। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর সেন এবং কাদের জামিলির মত বাঘা বাঘা বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞরা। প্রথমে খুব ভয় হয়েছিল। তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। মাত্র ১৫ মিনিটের একক সংগীত অনুষ্ঠান করে তাঁদের বাহবা প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।”

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ফরিদা পারভীনের গানে হাতে খড়ি হলেও চৌদ্দ বছর বয়সে নজরুল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান। লালন ফকিরের, ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ এ গান দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু। গুরু মোকসেদ সাঁই এর অনুরোধে স্বাধীনতা পরবর্তী কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়া ছেঁউড়িয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে তিনি প্রথম এই গানটি করেন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব দরবারেও তিনি লালন শাহের বানী ও সুর প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সারিবদ্ধ ভাবে বললে বলতে হবে, জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে লালন সংগীত পরিবেশন করেছেন, লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন। লালনের আধ্যাত্মিকতা মিশ্রিত এ গানের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। ৫৫ বছরের সংগীত চর্চার জীবনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন সংগীতে মুগ্ধ। দেশ বিদেশের সবখানেই তাঁর কণ্ঠে বেজেছে মরমি লালনের দর্শন। কালজয়ী সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে ‘খাচার ভিতর অচিন পাখি’ কিম্বা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ গান শোনেননি এমন শ্রোতা সংখ্যা খুবই কম। তিনি মনে করতেন, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার বিকল্প হতে পারে না।

তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদি’র নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিধিল গায়ে’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ ইত্যাদি।

আর অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধক আধুনিক, লালন নামে একটি ক্যাসেট। আরশিনগরের ব্যানারে, ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘আশাপূর্ণ হলো না’। হিন্দি ভাষায় লালনের ২০ টি কালজয়ী গান ‘লালন শাহ ফকির কি গীত’ আকারে অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।

ফরিদা পারভীনের পারিবারিক জীবনের দিকে আলোকপাত করে আজকের কাহিনীর যবনিকাপাত করবো। ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী অধ্যাপক আবু জাফর। সেই সংসারে তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরী উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী বংশীবাদক বা বাঁশি শিল্পী গাজী আব্দুল হাকিম।

একেবারে উপসংহারে বলবো, লালনের মরমি গান গেয়ে দেশবিদেশে খ্যাতি কুড়ানো যেসব শিল্পী আছেন, তাঁদের সবার শীর্ষে আছেন এ প্রয়াত বরেণ্য শিল্পী যিনি ‘লালন কন্যা’ নামে খ্যাত। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান নির্বাচিত করেছে, তার মধ্যেও আছে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ নামক এই গানটি বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি গানের অন্যতম একটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

লালন সংগীত ছাড়াও আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। শুরুতে নজরুল সংগীত শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পল্লীগীতিতেও তাঁর কণ্ঠে অসাধারণ দরদি হয়ে ওঠে।

পরিশেষে বলি, গানের মাঝে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন দর্শক শ্রোতার অন্তরে। লালন সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী সাধক ফরিদা পারভীন সুরের আকাশে অবিস্মরণীয় তারকা হয়ে থাকবেন।

(লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন