বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২

পর্যটন খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার গুরুত্ব

ড. মোঃ ওয়াসিউল ইসলাম

নিরাপত্তা (Safety) ও সুরক্ষা (Security) হলো পর্যটন শিল্পের একটি মৌলিক স্তম্ভ। পর্যটন শিল্প হলো একটি বহুমাত্রিক খাত, যেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (২০১৬) উল্লেখ করেছে যে, নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ না থাকলে পর্যটন কখনোই টেকসই হতে পারে না।

নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সরাসরি পর্যটকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অভিজ্ঞতা অর্জন এবং গন্তব্যের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে যা কোনো পর্যটন গন্তব্য বা ব্যবসার জন্য ‘চালনার লাইসেন্স’ হিসাবে আমরা ভাবতে পারি। ভ্রমণ একটি ঐচ্ছিক ব্যয়, মানুষ কেবল তখনই সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করবে যখন তারা নিশ্চিত থাকবে যে, ভ্রমণটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে। এটি ছাড়া অন্যান্য সব দিক যেমন মার্কেটিং, আকর্ষণীয় স্থান, অবকাঠামো এসবই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সুরক্ষা’ – পর্যটন খাতে এ দুটি বিষয় নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করতে চাচ্ছি। শব্দ দুটি প্রায়শই একে অপরের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হলেও তাদের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। উভয়ই পর্যটকদের জন্য একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে, তবে তারা ভিন্ন ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে। প্রথমেই আসুন পর্যটন খাতে ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সুরক্ষা’র মধ্যে তফাতগুলো বুঝে নিই।

প্রথমে নিরাপত্তা : নিরাপত্তা হলো দুর্ঘটনাজনিত বা অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি (যেমন: যে কোন দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যঝুঁকি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ) থেকে সুরক্ষা প্রদান বা প্রতিরোধ করা। নিরাপত্তার মাধ্যমে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা প্রাকৃতিক ঝুঁকি থেকে পর্যটকদের সুরক্ষাকে বুঝায়।

উদাহরণ স্বরূপ সড়ক, নৌকা বা বিমানে দুর্ঘটনা এড়ানো, খাবারের স্বাস্থ্যবিধি ও বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা, চিকিৎসা সুবিধা ও প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, হোটেল, ওয়াকওয়ে, রিসোর্ট, ভিউ পয়েন্টে নিরাপদ অবকাঠামো, অগ্নি-নিরাপত্তা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পের প্রস্তুতি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি, সুন্দরবনে নৌকাভ্রমণের সময় লাইফজ্যাকেট ব্যবহার, প্রশিক্ষিত ইকো-গাইড ও নৌ-চালক রাখা, সাবধানে জাহাজে বা নৌকায় আহরণ ও অবতরণ, কক্সবাজারে সমুদ্রস্নানের সময় সতর্কীকরণ পতাকা, লাইফগার্ড ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, সাজেকে বা পার্বত্য অঞ্চলে অতিরিক্ত সাবধানতায় গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিতকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেইলে সুরক্ষিত হাঁটার পথ তৈরি ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত : সুরক্ষা। সুরক্ষা হলো ইচ্ছাকৃত বা মানুষের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি (যেমন: অপরাধ, সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, প্রতারণা) থেকে প্রতিকার পাওয়া। উদাহরণ স্বরূপ চুরি, ডাকাতি বা প্রতারণা থেকে পর্যটকদের রক্ষা, সন্ত্রাসবাদ বা রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ, হয়রানি বা হামলা প্রতিরোধ, পর্যটকদের ডিজিটাল তথ্য ও আর্থিক লেনদেন সুরক্ষিত রাখা, ট্যুরিজম পুলিশ, নজরদারি ক্যামেরা ও শক্তিশালী আইন প্রয়োগ উল্লেখ্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় ট্যুরিজম পুলিশের টহল, ঢাকার ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে পর্যটক নিরাপত্তায় সিসিটিভি ব্যবহার, সুন্দরবনে বনদস্যু দমন অভিযান, যাতে পর্যটকরা নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারেন।

পরিশেষে, নিরাপত্তা মূলত অনিচ্ছাকৃত ঝুঁকি (দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্য সমস্যা) প্রতিরোধে মনোযোগ দেয় ও সুরক্ষা মূলত ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি (অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, প্রতারণা) প্রতিরোধে মনোযোগ দেয়। পর্যটন খাতে উভয়ই পরস্পরের পরিপূরক, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা একসাথে নিশ্চিত না করলে কোনো পর্যটন গন্তব্য নির্ভরযোগ্য বা আকর্ষণীয় হতে পারে না।
এবার আসুন, পর্যটন খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার গুরুত্বকে কয়েকটি মাত্রায় বুঝার চেষ্টা করি।

পর্যটকদের জন্য গুরুত্ব (চাহিদা দিক)

এটি সবচেয়ে প্রত্যক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষা হলো গন্তব্য নির্বাচন করার প্রধান অনুপ্রেরণা (বা প্রতিবন্ধকতা)।

পর্যটকের আস্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ : ভ্রমণকারীরা সেই গন্তব্যগুলোই বেছে নেয় যেখানে তারা নিজেদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত মনে করে। অপরাধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পর্যটক আগমনকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করে। উদাহরণ: কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সন্ত্রাসী হামলা হলে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা হঠাৎ করে কমে যায়।

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা : মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদা হলো নিরাপত্তা। পর্যটকরা ক্ষতি, অপরাধ, দুর্ঘটনা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই সুরক্ষা তাদেরকে আরাম করে ভ্রমণ উপভোগ করতে সাহায্য করে।

ভ্রমণের আত্মবিশ্বাস : নিরাপত্তা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পর্যটকদের ট্রিপ বুক করতে, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মেলামেশা করতে উৎসাহিত করে। নেতিবাচক ধারণা যেমন অপরাধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত খবর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের বিকল্প গন্তব্য বেছে নিতে বাধ্য করে।

ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি : নিরাপদ পরিবেশ একটি আনন্দদায়ক ভ্রমণ স্মৃতির পূর্বশর্ত। একটি মাত্র চুরির ঘটনা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, বা পরিবহন দুর্ঘটনা পুরো ভ্রমণ নষ্ট করে দিতে পারে এবং এমন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা মুখে মুখে ছড়িয়ে অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করে।

গন্তব্য ও আতিথ্য প্রদানকারী সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্ব (সরবরাহ দিক)

একটি দেশ, অঞ্চল বা শহরের জন্য নিরাপত্তা বিষয়ক সুনাম হলো পর্যটন খাতে সবচেয়ে মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি : পর্যটন অসংখ্য গন্তব্যের রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা এবং কর্মসংস্থানের বড় উৎস। নিরাপদ পরিবেশ বেশি পর্যটক আকর্ষণ করে, যা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন সেবা, গাইডসহ দর্শনীয় স্থান ও স্থানীয় দোকানে ব্যয় বৃদ্ধি করে। অনিরাপত্তা ভ্রমণ বাতিল, আয় হ্রাস ও চাকরি হারানোর দিকে নিয়ে যায়।

গন্তব্যের সুনাম ও ব্র্যান্ড ইমেজ : নিরাপত্তা ও সুরক্ষা একটি পর্যটন গন্তব্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি তৈরি করে। ইতিবাচক ব্র্যান্ড তৈরি দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, কিন্তু নিরাপত্তাজনিত সংকট একে মুহূর্তেই তা ধ্বংস করে দিতে পারে। শক্তিশালী নিরাপত্তা রেকর্ড গন্তব্যের ব্র্যান্ডকে সমৃদ্ধ করে, এটিকে ‘অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত’ স্থানে পরিণত করে, ‘যে কোনো মূল্যে এড়িয়ে চলা’ নয়। উদাহরণ: কম অপরাধের হার বিশিষ্ট দেশগুলো (যেমন: সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড) ‘নিরাপদ পর্যটন গন্তব্য’ হিসেবে পরিচিত এবং লাখো পর্যটক আকর্ষণ করে।

টেকসই পর্যটন উন্নয়ন : নিরাপদ পর্যটন দীর্ঘ সময় থাকা, বেশি ব্যয় করা এবং পুনরায় ভ্রমণে উৎসাহিত করে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়কে অবকাঠামো ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে, কারণ পর্যটন আয় প্রবাহ স্থিতিশীল থাকে। অনিরাপদ পর্যটন অস্থির ও অটেকসই।

সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা : নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঐতিহাসিক স্থান, জাদুঘর ও প্রাকৃতিক/জাতীয় উদ্যানকে ধ্বংস, চুরি ও অতিরিক্ত ভিড় থেকে রক্ষা করে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এগুলো অক্ষত থাকে।

আইনগত ও নীতিগত বাধ্যবাধকতা : সরকারগুলোর দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক পর্যটন মানদণ্ড অনুযায়ী ভ্রমণকারীদের সুরক্ষা প্রদান। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা (আইন, পর্যটন পুলিশ, জরুরি হটলাইন, বীমা ব্যবস্থা) গন্তব্যের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে।

পর্যটন ব্যবসার জন্য গুরুত্ব

একক ব্যবসার ক্ষেত্রে হোটেল, এয়ারলাইনস, ট্যুর অপারেটর ইত্যাদির নিরাপত্তা সরাসরি তাদের টিকে থাকা ও আইনগত অবস্থার সাথে সম্পর্কিত।

যত্ন নেওয়ার দায়বদ্ধতা : ব্যবসার আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব হলো অতিথি, কর্মী ও সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে বিশাল মামলা, সুনাম নষ্ট হওয়া এবং দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি থাকে।

প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা : যে প্রতিষ্ঠান কঠোর নিরাপত্তা মান বজায় রাখে (যেমন: অসাধারণ নিরাপত্তা রেকর্ড সম্পন্ন এয়ারলাইন বা খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিধিতে উৎকৃষ্ট হোটেল) তারা বড় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পায়।

কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা : বড় নিরাপত্তা সমস্যা কোনো ব্যবসাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। অগ্নি মহড়া, কর্মী প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যবিধি প্রোটোকলের মতো সক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে মসৃণ ও ধারাবাহিক রাখতে সাহায্য করে।

কর্মীদের মনোবল ধরে রাখা : যারা কর্মস্থলে নিরাপদ ও সুরক্ষিত বোধ করে তারা বেশি উৎপাদনশীল, ভালো সেবা দেয় এবং দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানে থাকতে আগ্রহী হয়।

পর্যটনে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রধান মাত্রা

এই ধারণাটি ব্যাপক এবং নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে :

কাঠামোগত নিরাপত্তা : ভবনের কাঠামোগত দৃঢ়তা, ভিউপয়েন্টে রেলিং, নিরাপদ হাঁটার পথ, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সরঞ্জামের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ।

স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি : খাদ্যের নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সুবিধা। কোভিড-১৯ মহামারি এই মাত্রাকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।

রাজনৈতিক নিরাপত্তা : সন্ত্রাসবাদ, গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধ ও অপরাধ (চুরি, প্রতারণা, হামলা) থেকে মুক্তি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা : পর্যটকদের ডিজিটাল ডেটা ও আর্থিক লেনদেন সুরক্ষিত রাখা, ভ্রমণের সময় অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

পরিবেশগত নিরাপত্তা : প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতি খরা, ভূমি ধস) থেকে সুরক্ষা দিতে আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা।

পর্যটনে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চিত করা বিষয়টি একটি যৌথ দায়িত্ব, একক কোনো সংস্থার দায়িত্ব নয়, যেখানে সাধারণত: নিম্নবর্ণিত সংস্থাসমূহ অংশগ্রহণ করে থাকে।

সরকার : (জাতীয়, আঞ্চলিক, স্থানীয়) কার্যকর আইন, পুলিশি ব্যবস্থা, জরুরি সেবা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো প্রদান করে।

পর্যটন কর্তৃপক্ষ : নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ, সঠিক ভ্রমণ পরামর্শ প্রদান এবং
গন্তব্যের সুনাম ব্যবস্থাপনা করে।

বেসরকারি খাত : নিরাপত্তা প্রোটোকল বাস্তবায়ন, কর্মী প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ সুবিধা বজায় রাখে।

স্থানীয় সম্প্রদায় : অতিথিপরায়ণ হওয়া গন্তব্যের চোখ ও কান হিসেবে কাজ করে।

পর্যটকরা নিজেরা : চারপাশ সম্পর্কে সচেতন থাকে, স্থানীয় আইন ও রীতিনীতি মেনে চলে এবং সমন্বিত ভ্রমণ বীমা গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে পর্যটন খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সমস্যাসমূহ

অপরাধ ও সাধারণ অপরাধমূলক ঘটনা : চুরি, মগিং, গাড়ি-রিকশা-ট্যাক্সি চালকদের ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়া বা অতিরিক্ত ফি আদায় ইত্যাদি অভিযোগ পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হিংসার প্রভাব : দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, পার্বত্য অঞ্চলের অস্থিরতা, নির্বাচনকালীন অসহিষ্ণুতা, পরিবহন ধর্মঘট, ইত্যাদি পর্যটন খাতকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

পর্যটক-সহায়তার অবকাঠামোর ঘাটতি : অনেক পর্যটন স্পটে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা, লাইফগার্ড, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তামূলক সাইনবোর্ড বা জরুরি সহায়তার টিম পাওয়া যায় না।

পর্যটন জনমত ও বিশ্বাসের অভাব : অনেক বিদেশি পর্যটক এবং ট্যুর অপারেটর মনে করেন করোনা, নিরাপত্তা ইস্যু ও দেশের ভাবমূর্তি (ইমেজ) বাংলাদেশের পর্যটন-গন্তব্য হিসেবে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি করছে।

সম্প্রতি (বিশেষতঃ কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে), দেশে যেমন অভ্যন্তরীণ পর্যটনের পরিমাণ বেড়েছে তেমনি এ খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টিও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সঠিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পরিষেবার অভাবে সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনার পরিমাণও বেড়েছে যা এ খাতের উন্নয়নে একটি বড় বাধা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই সড়ক ও নৌপথে এ ধরনের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। পর্যটন খাতে এ ধরনের দুর্ঘটনার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও তা যে দিন দিন বেড়ে চলেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। লাইসেন্স বিহীন অদক্ষ চালক, চালকদের মাদকাসক্ততা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, অনিরাপদ সড়ক, সড়কে তদারকির অভাব, পর্যটকদের অসচেতনটা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব, একটি গন্তব্যের পর্যটকদের ধারণ ক্ষমতা নির্ধারিত না থাকা, ইত্যাদির কারণে বিশেষত সড়ক পথে পর্যটকবাহী যানবহনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করাও একটি অন্যতম কারণ।

উপরের আলোচনায় আমরা হয়তো এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, পর্যটন খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা উভয়ই অপরিহার্য যা এই খাতের মৌলিক সক্ষমতাকারী উপাদান হিসাবে বিবেচিত। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পর্যটকদের সুরক্ষা, আর সুরক্ষা প্রতিরোধ করে অপরাধ ও সহিংসতার মতো মানবসৃষ্ট ঝুঁকি। এগুলো পর্যটক আগমন ও কল্যাণ রক্ষা করে, গন্তব্য ও ব্যবসার অর্থনৈতিক স্বার্থ ও খ্যাতি সুরক্ষিত করে, এবং সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই সংরক্ষণকে প্রভাবিত করে – যা মূলত ঐ গন্তব্যে পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পর্যটন খাতে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা উভয়ই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তাই একটি টেকসই ও সফল পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে হলে সরকার, বেসরকারি খাত, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং পর্যটকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : wasiulislam7@yahoo.com

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন