২০০৩ সালের মার্চ মাস। কলকাতার রবীন্দ্র সদন এলাকার আকাদেমী অব ফাইন আর্টসের কনফারেন্স রুমে ‘ অনুপ্রবেশ ও বাস্তব ভিত্তি’ শীর্ষক একটা সেমিনার হয়েছিল। কলকাতার এক সাপ্তাহিক পত্রিকা এই সেমিনারের আয়োজক। সেখানে তখনকার শাসক দল সিপিআইএম, প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস থেকে শুরু করে ছোট-বড়-মাঝারি সব দলই ছিল। কিন্তু ওই সেমিনারে দু-একজন বক্তার বেশ কিছু পয়েন্ট ভিত্তিক বক্তব্য দারুণভাবে শ্রোতাদের আকর্ষণ করেছিল। এদের মধ্যে একজন হলেন এককালের হুমায়ুন কবীর ও আতাউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের ম্যাগাজিন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুর রাউফ, অন্যজন হলেন অসমের অ্যাডভোকেট জেনারেল আবুল হোসেন মজুমদার । দুজনেই আজ পরপারে। আব্দুর রাউফ সেদিন বলেছিলেন, ‘ভাই ভাইকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। তাহলে এই অবৈধ বাংলাদেশীকে আমরা এমনি এমনি জায়গা দেব?’
অন্যদিকে অসম রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল আবুল হোসেন বলেছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে (এখন সেভেন সিস্টার্স হিসাবে খুব জনপ্রিয়) এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে হলে ‘ ইনার পারমিট’ লাগে। তাহলে অনুপ্রবেশ হয় কীভাবে? দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়?
ওই বছর কলকাতার বিখ্যাত সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে অডিটোরিয়া ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা, একসময় যিনি ভারতের অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী তথা ভারতের রাষ্ট্রপতির মতো পদের অধিকারী প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, কম অর্থনৈতিক দেশের মানুষ কাছাকাছি বেশি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশে ধাবিত হন অর্থনৈতিক কারণেই। কিন্তু এখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্রমশ এগোচ্ছে। কেন পাশে নেপাল-ভুটান থেকেও তো আমাদের দেশে লোক আসছেন ঢালাও হারে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে, সেই প্রণব মুখোপাধ্যায় পরে আর এস এসের সভাতে গিয়ে ঢালাও প্রশংসা করলেন ওই উগ্রহিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির। আর নরেন্দ্র মোদীজীকে ঢালাও ‘গুড সার্টিফিকেট ‘ দিলেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে হিন্দু মহাসভা থেকে জন সঙ্ঘ তারপর আজকের বিজেপি হল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২ টি আসন। হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে সেই বিজেপি ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৮৮টি আসন পেল। তারপর নব্বইয়ের দশকে রামমন্দির ধুয়ো তুলে ১৯৯৯-২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলো। কিন্তু সেই সরকার ছিল অনেকটাই সংখ্যালঘু। আর মোদীকে প্রোজেক্ট করে ২০১৪ থেকে তিন তিনবার বিজেপি ক্ষমতাসীন। বাবরির স্হলে বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে রামমন্দির তৈরি হল। আর এখনো অনুপ্রবেশ তাদের মাথায় খেলে শুধু নয়, ভূতের মতো চেপে বসে রয়েছে। আরএসএস তার অঙ্গ সংগঠনের সংখ্যা বাড়িয়ে তাদেরকে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারীর তত্ত্বের প্রচারটা ব্যাপক করছে। গোয়েবেলসের থিওরিরর মতোই বারবার বলে অনুপ্রবেশকে সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করছে। আর এই অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে বিজেপি শাসিত ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্যে বাঙালি শ্রমিক বা বাংলাভাষীদের অনুপ্রবেশকারী সাজিয়ে ব্যাপক হেনস্থা ও নির্যাতন করছে। বাংলাদেশী তকমা লাগিয়ে পুশ-ইন বা পুশ-ব্যাক করে হয়রানি করছে। খুনের ঘটনাও ঘটছে। বাংলাভাষীদের উপর নেমে এসেছে এক বিশাল অভিশাপ। এ এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পরিস্হিতি। নিজভূমিতে পরবাসীর মতো অবস্হা। সব থেকে বড় কথা হল, অসমের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা তো বাংলাভাষী হলেই তাকে পুরো বিদেশি বলে উল্লেখ করছেন। এর শিকার যেমন হচ্ছেন অসমের বাঙালিরা। তেমনি শিকার হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুর, নদীয়া , মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম,পূর্ব বর্ধমানের বঙ্গভাষীরা। এমনিতেই এনআরসিসিএএ এবং এনআরসি’র কোপে পড়ে অসমের ৪০ লাখ বাঙালি আজ ডিটেনশন ক্যাম্পে। এদের মধ্যেই ৩৮ লাখ হিন্দু বাঙালি।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড, গুজরাট মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্হান, অসম, মেঘালয়, দক্ষিণ ভারতের কেরালা, কর্ণাটক, তামিনলাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে বিশাল সংখ্যক বাংলাভাষী শ্রমিক নানান পেশাতে কাজ করেন। এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম থাকলেও মুসলিমদের সংখ্যা বেশি। কৃষিকাজ থেকে জরি, পাঞ্জাবির ফুল, রেডিমেড বস্ত্র, রাজমিস্ত্রিসহ এই বাংলাভাষী বা বাঙালি শ্রমিকরা ওই রাজ্যগুলিতে কাজ করেন। এদেরকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী সাজিয়ে পুশ-ইন করাই হল মোদী সরকারের প্রধান লক্ষ্য। অথচ এদের দশ পুরুষ এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই জন্ম। এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই লালিত-পালিত।
এ বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। বিহারের শ্রমজীবী ও বাঙালি শ্রমিকরা এবার ভোটাধিকার হারাবে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর -এর যুপকাষ্টে বলি হয়ে। অন্যদিকে এইআইএসআর এ বছরের আগস্টে পশ্চিমবঙ্গেও চালু হয়ে গেছে। সাত পুরুষ ধরে বসবাসকারী বাঙালি বা বাংলাভাষীরাও ভোটারহীন হবেন। সব মিলিয়ে ভারতের বাংলাভাষীরা একরকম বিপন্নতার মধ্যেই।
অনুপ্রবেশকারী তকমা একদিকে, অন্যদিকে এনআরসিসিএএ, এনআরপি এবং সাম্প্রতিক এসআইআর-এ বলি হয়ে বাঙালিরা গভীর সঙ্কটে।
কিন্তু সত্যিই কি অনুপ্রবেশ ঘটছে? ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ-এর জুরিসডিকেশন বেড়েছে সীমান্ত থেকে আরও ৫০ কিলোমিটার ভিতরে। তাহলে অনুপ্রবেশ হয় কী করে। আরো একটা কথা হল, বাংলাদেশে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে তাদের জিডিপি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেড়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে তারা বেশ কিছু এগিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের একজন রিক্সাওয়ালার দৈনিক আয় তিন হাজার টাকা গড়ে। তাদের দেশ গার্মেন্টস বা বেশ কিছু সেক্টরে দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলিতে তারা পেশাজীবী হিসাবে কাজ করছেন। তাহলে কেন তারা ভারতে আসবে? এটাই হল প্রধান বাস্তবতা। গোয়েবিলসীয় থিওরির মতোই অনুপ্রবেশকে সত্য করতে ভারতের বঙ্গভাষী জাতি সত্ত্বাকেই শেষ করে দিতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি এবং কর্পোরেট লবি। ধর্মীয় বিভাজন ও ভাষাভিত্তিক বিভাজনে দেশটি ক্রমশ সঙ্কটে। চাড়া দেবে প্রাদেশিকতা ও আঞ্চলিকতা। আজ মনিপুরের আদিবাসী জনজাতি দাঙ্গা ভারতকে ইতিমধ্যেই সঙ্কটে ফেলেছে। ভারতের বঙ্গভাষীরাও আজ ঘোর সঙ্কটে।
লেখক : কলকাতার একজন প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কবি
খুলনা গেজেট/এনএম