Edit Content
খুলনা বাংলাদেশ
বৃহস্পতিবার । ২৪শে জুলাই, ২০২৫ । ৯ই শ্রাবণ, ১৪৩২

ই-পেপার

Edit Content

সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ সমাজের শৃঙ্খলার বাঁধন আলগা করছে যেভাবে

রুশাইদ আহমেদ

চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে খণ্ডায়িত রাঢ়, বরেন্দ্র, দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার আপামর বিচ্ছিন্ন জনপদকে একত্রিত করার প্রয়াস নেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। এর মধ্য দিয়ে দিল্লির শাসন থেকে বিভাজিত বাংলাকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ এক জাতিসত্তা বিনির্মাণের পথে তিনি শুরু করেন একটু একটু করে আগাতে। জন্ম হয় উপমহাদেশের এক অনবদ্য সমৃদ্ধিশালী জনগোষ্ঠীর।

কিন্তু কালের বিবর্তনে ‘বাঙ্গালাহ’ নামে খ্যাতি পাওয়া সেই জনপদের বাসিন্দাদের বর্ধনশীল নৈতিক স্খলনের মাত্রা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি নিম্নগামী আগ্রহের ধারা ক্রমান্বয়ে অঞ্চলটির জন্য অভিশাপ হয়ে উঠতে থাকে। ফলে বর্তমানে বৈশ্বায়নের যুগে পৌঁছে এই দেশের সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলার বাঁধন হয়ে পড়েছে নানা দিক থেকে আলগা।

কিন্তু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার নেপথ্যে কোন কোন কারণ রয়েছে? আমাদের ঐক্যবদ্ধ সমাজ কাঠামো ক্রমশ এভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়ার কারণে কী কী দুর্যোগই বা ঘটতে পারে? এসব বিষয়ে সচরাচর কেউ আলোকপাত করতে চান না। কিন্তু জাতির সার্বিক উন্নয়ন সুনিশ্চিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আলাপ করা ফরজে কিফায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আদতে, প্রত্যেকটা জনপদ বা জনগোষ্ঠীর আত্মবিকাশ নিশ্চিতের সর্বোত্তম পথ হলো নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতন্ত্র উপাদানগুলোকে ধারণ করে সামনে অগ্রসর হওয়া। ফলে একটি জাতির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে তার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার ক্রমাগত অপপ্রয়াস। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের কথা উল্লেখ করতে গেলেও এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

এরই সূত্র ধরে আমাদের সামনে চলে আসে বাংলাদেশে পশ্চিমা ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের স্বরূপ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ‘বাঙ্গালাহ সালতানাত’ আমলে আমাদের জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক রীতিনীতির মূল উপজীব্য ছিল স্থানীয় ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সোপানসমূহ। এসবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল আমাদের দৃঢ় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল অবকাঠামো।

কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ভারতবর্ষে কর্তৃত্ব স্থাপনের পর থেকে ইউরোপীয় এবং মৌলিক বাঙালি সংস্কৃতির সংকরায়ণ ঘটতে থাকে। নিজেদের শাসনকাঠামোর ভিত পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমা আদলের শিক্ষা, যোগাযোগ ও আমলাতান্ত্রিক পরিসর গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের সকল সাংস্কৃতিক উপাদানের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করা হয়।

ফলে এখন আমরা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, ধুতি বা অন্যান্য বাঙালি পোশাকের বদলে ভদ্রসমাজের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে গায়ে জড়িয়েছি আধুনিক প্যান্ট, শার্ট, কোট, টাই, প্রভৃতি। মাতৃভাষায় কথা বলার সময় তিন-চারটে ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ না করলেও আমাদের আর চলে না। এমনকি গত জুন মাসে নিজ বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে আদালতে এক কিশোরীর মামলা দায়েরের ঘটনাও পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণার স্ফীত কুণ্ডলী থেকেই তৈরি হয়েছে।

একইভাবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। এমনকি বাংলা একাডেমির বানান রীতিতেও ঢুকে পড়ে দেশটির সংস্কৃতায়নের আগ্রাসী ভাষার রাজনীতি। সামনে আসে সাহিত্যে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ অসামঞ্জস্য দ্বন্দ্ব। বিভাজনের সূত্রপাত ঘটে এখানেই।

অথচ অতীতের স্বাধীন সুলতানি আমলে মুসলিম-হিন্দুসহ সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ এক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে জীবনযাপন করতেন এই ভূখণ্ডে। শাসনব্যবস্থায় ইসলাম ধর্ম ও বাঙালিয়ানার মিশেল থাকলেও, তা কখনো কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা কিংবা সহিংসতার উদ্রেক ঘটায়নি সে সময়ে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝ পর্যায়ে পৌঁছে উপনিবেশবাদীদের উদ্ভাবিত বিভক্তিকরণ পরিকল্পনার আওতায় অঞ্চলটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।

পাশাপাশি, উপনিবেশবাদী বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, উদীচী ও ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রচেষ্টায় মূল বাঙালিয়ানার স্বভাববিরুদ্ধ উপাদান আমাদের সংস্কৃতিকে উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। ফলে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। সামনে আসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক।

একই পরিপ্রেক্ষিতে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আকাশ ও স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ইন্টারনেট পরিষেবা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধে আরেক বিপত্তি। পশ্চিমা ও ভারতীয় নানা বিজাতীয় মেগা সিরিয়াল থেকে শুরু করে অনলাইন ভিজ্যুয়াল বা টেক্সট উভয় ধরনের পরিবারব্যবস্থা বিধ্বংসী ডিজিটাল কন্টেন্টে সয়লাব হতে শুরু করে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো।

এ কারণে বর্তমানে আমাদের সমাজে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াল থাবা। মাদকাসক্তি, অশ্লীলতা, পরকিয়া, বিচ্ছেদ, পারিবারিক ভাঙন, যৌন অনাচার, ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা, খুন, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, প্রভৃতি অনৈতিক ও অপরাধমূলক ঘটনাবলীতে বিপর্যস্ত হচ্ছে গোটা সামাজিক কাঠামো।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সংঘটিত বিবাহ বিচ্ছেদের প্রায় ৮০%-ই ঘটেছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোয় সম্প্রচারিত অপসংস্কৃতিতে ভরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গল্প হতে উদ্বুদ্ধ হয়ে। এ ছাড়া, ভারতীয় সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে দেশে (প্রতিদিনের সংবাদ, ১৭ জুলাই ২০২১)।

এসবই আমাদের স্থিতিশীল, শান্তি ও সম্প্রীতিময় সমাজের শৃঙ্খলার বাঁধন আলগা করতে কালপরম্পরায় বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের পরিচালিত মিশনগুলোতে সফলতা অর্জনের ফসল।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নানা ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে জোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। সে দিক থেকে, এই ধরনের অভিশপ্ত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে সুস্থ ধারার প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতি পুনঃপ্রচলনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না।

ইতিমধ্যে চলতি বছরের বাংলা নববর্ষ ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনে যে ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতির অনুসরণ করা হয়েছে, তা দেশের জনসাধারণের মনে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। তবু এরপরও আমাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিপূর্ণ পুনর্জাগরণ নিশ্চিতে অন্যান্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। মূলত, এই প্রয়োজনীয়তার উৎসমূল আমাদের অনন্য সংস্কৃতিকে রক্ষার পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নের মধ্যে প্রোথিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন