মঙ্গলবার । ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২
সঞ্চয়পত্রের সার্ভারে জালিয়াতি

ছাত্রদলের সাবেক নেতাসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

গেজেট প্রতিবেদন

সঞ্চয়পত্রের সার্ভারে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নেতার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে পরিচয় শনাক্তকারী মহিউদ্দিন আহমেদও এতে আসামি।

অপর দুই আসামি হলেন– এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপ-শাখার গ্রাহক মো. আরিফুর রহমান মিম এবং তার পরিচয় শনাক্তকারী আল আমিন।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে অতিরিক্ত পরিচালক আবুল খায়ের মো. খালিদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এরপরই আরিফুর রহমানকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনির ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের কাওরানবাজার শাখার ব্যাংক হিসাবে দুইটি সঞ্চয়পত্রের ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়। অবশ্য এই অর্থ উত্তোলনের আগেই তা আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর মহা-হিসাব নিরীক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তা এসএম রেজভীর ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুরের রানীগঞ্জ উপ-শাখার মো. আরিফুর রহমান মিমের অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয়। টাকা জমা হওয়ার পরই ঢাকার দুইটি শাখা থেকে তা নগদে তুলে নেওয়া হয়। এই আরিফের লেনদেন সীমা ছিলো ২ লাখ টাকা। তবে জালিয়াতির মাধ্যমে লেনদেন সীমা ১০ লাখ টাকা করা হয়। জালিয়াতির স্বীকার তিনটি সঞ্চয়পত্রই কেনা হয়েছে চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে।

মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন জানান, চার আসামির মধ্যে আরিফুর রহমানকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

কে এই ছাত্রদল নেতা
জানা গেছে, মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭–০৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রদলের সভাপতি থেকে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হন। তার বাবা মোহাম্মদ আব্দুল কাদির, মাতা– হাওয়া বেগম। আর বাসা ঢাকার তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায়। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুরে।

মোহাম্মদ মারুফ এলাহী রনির দাবি, ‘এই জালিয়াতির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আজ বৃহস্পতিবার টেলিফোনে তিনি সমকালকে বলেন, ‘ডাচ্–বাংলা ব্যাংকে আমার হিসাবটি ছাত্র অবস্থায় ২০০৮ সালে খোলা। এই হিসাবে আমার লেনদেন সীমা ৫ লাখ টাকা। বর্তমান ব্যালেন্স আছে ৩৫ হাজার ৭০০ টাকার মতো। কে, কেন, কীভাবে ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমি কিছুই জানি না। মঙ্গলবার প্রথম এটা শুনেছি। এরপর থেকে আমার হিসাব থেকে আর লেনদেন করতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলাম। সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। রাজনৈতিকভাবে আমাকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এরকম করেছে কিনা বুঝে আসছে না।’

যেভাবে জালিয়াতি
সঞ্চয়পত্রের সার্ভারে কীভাবে জালিয়াতি হয়েছে তার বর্ণনা উঠে এসেছে মামলার এজহারে। এতে বলা হয়েছে, গত ২৭ অক্টোবর বিকেল ৪টার দিকে মহা-হিসাব নিরীক্ষণ কার্যালয়ের হিসাব নিরীক্ষণ কর্মকর্তা মঞ্জুর আলম জানান, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসএম রেজভী আয়কর রিটার্ন পূরণ করতে গিয়ে দেখেন, গত ১৩ অক্টোবর কেনা ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র নগদায়ন হিসেবে দেখাচ্ছে। অথচ তিনি নগদায়নের কোনো আবেদনই করেননি। বিষয়টি জানতে পেরে যাচাই করে দেখা যায়, গত ২৩ অক্টোবর তা নগদায়ন করা হয়েছে। তবে শাখায় নগদায়নের কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে অধিকতর যাচাই করার জন্য যে সফ্‌টওয়্যার ব্যবহার করে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা হয় ‘এসপিএফএমএস’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, প্রথমে গত ২২ অক্টোবর এই গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করা হয়। এরপর ব্যাংক হিসাবের তথ্য পরিবর্তন করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের দিনাজপুরের রানীগঞ্জ উপশাখায় আরিফুর রহমানের তথ্য দেওয়া হয়।

আরিফুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে গত ২৬ অক্টোবর এই সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করা হয়। বিষয়টি জানার পরই গত সোমবার মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা এসএম রেজভী গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের নির্বাহী পরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, আরিফুর রহমানের লেনদেন প্রোফাইলের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে তার জমা ও উত্তোলনের সীমা ২ লাখ টাকা। পরবর্তীতে টেম্পারিং করে, যা ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে।

মারুফ এলাহীর বিষয়ে মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার হিসাবে গত ২৭ অক্টোবর দুইটি সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ৫০ লাখ টাকা নগদায়ন হয়। দু’টি সঞ্চয়পত্রই ছিলো পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। এর মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মো. সাইদুর রহমানের নামে ৩০ লাখ এবং গত ১৭ সেপ্টেম্বর মো. আবুল হাসান মজুমদারের ২০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের সঞ্চয়পত্র শাখা ও কম্পিউটার সেলের দ্রুত পদক্ষেপের কারণে গত ২৮ অক্টোবর দুইটি ইএফটি বাবদ ৫০ লাখ টাকা ডাচ্–বাংলা ব্যাংক থেকে পুনরুদ্ধার করে সরকারি খাতে জমা করা হয়।

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, এসব আসামিরা একে অপরের সহায়তায় বেআইনিভাবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া ইউজার আইডিতে গোপনে প্রবেশ করে। জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের মোবাইল নম্বর এবং হিসাব নম্বর পরিবর্তন করে অপরাধ করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। মামলার সঙ্গে এসব ব্যক্তিদের বিভিন্ন তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে ভোগান্তি
বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর ও পোস্ট অফিস মিলে প্রায় ১২ হাজার শাখা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো হয়। গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকসহ গ্রাহকদের তিন লাখ ৪০ হাজার ৭১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কেনা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে। এই অফিসের তিনজন সঞ্চয়পত্রের জালিয়াতি ধরা পড়ার পর গত মঙ্গলবার থেকে এই অফিসের সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহক। সুদ কিংবা আসল নগদায়ন করা যাচ্ছে না। নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, এতদিন মতিঝিল অফিসের যে তিনজনকে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিলো তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। আলামত হিসেবে এসব কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। গত বুধবার আবার সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে নতুন ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নেওয়া হয়েছে। যে কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। আগামী রোববার থেকে আশা করা যায় পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সন্দেহভাজন এসব হিসাব জব্দ করেছে। এ ঘটনার পর থেকে সঞ্চয় অধিদপ্তরের এনএসসি সিস্টেমের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ ও এনআরবিসি ব্যাংক থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন