বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে প্রবাসীদের মৃত্যুর মিছিল, প্রধান কারণ হার্ট অ্যাটাক

ফরহাদ হুসাইন, আমিরাত

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে, গত বছর (২০২৪ সালে) বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৮১৩ জন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত বছরের ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত মোট ৭শ ৪ জন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ বাংলাদেশে গেছে। একই সময়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত গত আট ৮ মাসে ৩৩৭৫ জন রেমিট্যান্স যোদ্ধার লাশ পাঠানো হয়েছে দেশে।হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে ৪ শতাধিক প্রবাসীর লাশ যায় বাংলাদেশে। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অধিকাংশ প্রবাসী কর্মীর মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ বা “হার্ট অ্যাটাক”।প্রবাসী কর্মীদের মানসিক চাপ, হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, অনিয়মিত ঘুম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিত না করাকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

আবুধাবি কমিউনিটিতে পরপোকারী হিসেবে পরিচিত জুলাই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকায় থাকা চট্টগ্রামের রাউজানের আব্দুল হামিদ। তরুণ এই যুবক কারাবরণ সহ নানা আইনি জটিলতায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে মারা যান।

দূতাবাসের তত্বাবধানে তার লাশ দেশে পৌঁছালেও সেই সৌভাগ্য হয়নি মোমেনার ক্ষেত্রে। দুবাইয়ের গৃহকর্মী মোমেনা হৃদরোগে মারা যান গত জানুয়ারিতে। যশোরের মেয়ে মোমেনার পরিবার লাশ পরিবহন খরচের পয়সা জোগাড় করতে পারিনি, ফলে দুবাইয়ের সোনাপুরে সমাহিত করা হয় দুই সন্তানের জননী মোমেনার মৃতদেহ।

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মোঃ হাসান সংযুক্ত আরবের দেশে আসেন চার বছর আগে। গত ২৭ মার্চ ২০২৫ কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। একই গাড়ীতে থাকা পাঁচজন শ্রমিক সকলে নিহত হন।

কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩২ বছরে ৫৭ হাজার ২১৬ প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। এই ৩২ বছরের তথ্যই বোর্ডের কাছে আছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিবছরই লাশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পাঠানো মৃতদেহের মৃত সনদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কেবল হৃদরোগে মারা গেছে ৫৬৪ জন। এছাড়া সড়ক দূর্ঘটনায় ৪৮ জন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ১৯ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৩২ জন ও অন্যান্য কারণে ৬১ জন মারা গেছেন।

কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এর বাইরে অনেক লাশ বিদেশের মাটিতেই দাফন করা হয়। অনেক পরিবার লাশ দেশে আনতে চান না। যার ফলে পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশেই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রবাসে বাড়ছে প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর মিছিল যার অন্যতম কারণ “হার্ট অ্যাটাক”। প্রবাসী বাংলাদেশি ও অভিবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘উচ্চ অভিবাসন ব্যয় প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ানোর অন্যতম কারণ। ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা পরিশোধ করার চাপের কারণে অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা রয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে। ১২-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না শ্রমিকেরা। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

এ বিষয়ে আবুধাবি প্রবাসী ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ রোকসানা আক্তার জানান, “সংযুক্ত আরব আমিরাত তথা বিদেশে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী হৃদরোগে অকাল মৃত্যুবরণ করছেন, এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিমিত খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। ধূমপান ও অতিরিক্ত চা-পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রবাসে থেকেও নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াই পরিবারের প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।”

প্রবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখতে পরিবার বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশী কমিউনিটির পরিচিত এই চিকিৎসক। প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর কারণ জানতে সরকারিভাবে কোনও গবেষণা করা হয়নি।

তবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রবাসীকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত বা ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে। আবার মৃতদের একটা বড় অংশই মধ্যবয়সী কিংবা তরুণ।

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ২০২৩ সালে ‘প্রাণঘাতী তাপ: উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী কর্মীদের ওপর চরম তাপমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অবকাঠামো নির্মাণ খাতে কাজ করে। এই শ্রমিকদের দিনের বেলায় প্রচণ্ড তাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। ফলে তাপজনিত নানা রোগে কিডনি, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব দেশে তাপ আরও বাড়ছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে অতিরিক্ত তাপ।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে প্রবাসীদের লাশের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৫ সালে লাশ এসেছে ১ হাজার ২৪৮ জনের, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৭৯৩, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬৫১ জন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ১৪০, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৮১৮ জন, ২০২২ সালে ৩ হাজার ৯০৪, ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৫৫২ জন এবং ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ জনের লাশ এসেছে দেশে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রবাসীদের লাশ সবচেয়ে বেশি আসে সৌদিআরব থেকে। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাশ দেশে আসে।

আরব আমিরাতের আবুধাবী দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) মোহাম্মদ উল্লাহ খান প্রতিবেদককে জানান, আবুধাবি দূতাবাস থেকে ২০২০ সালে ২৬২টি, ২০২১ সালে ২২১টি, ২০২২ সালে ২০৮টি, ২০২৩ সালে ২২০ টি এবং ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ২৪৪ টি মৃতদেহের ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন