রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কার কী অবস্থান, তা সংযোজন করা হয়েছে এতে। খসড়াটি গতকাল শনিবার ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের কাছে পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত জানাতে বলা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাওয়া সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না আদালতে। থাকছে আইনি ভিত্তিও।
পটভূমিসহ সনদটি ছয়টি ভাগে বিভক্ত– পটভূমি, ছয় সংস্কার কমিশন গঠন, ঐকমত্য কমিশন গঠন, কমিশনের কার্যক্রম, যে ৮৪ সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো এবং বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত পাওয়ার পর বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা হবে। এই আলোচনায় ঠিক করা হবে, কোন কোন সংস্কার প্রস্তাব আসন্ন নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য।
সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে গতকাল সংসদের কমিশন কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
বৈঠকে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেছেন, সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের যেসব মতামত পাওয়া গেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিএনপি আগেই জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত যেসব সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অধিকাংশ দল এতে রাজি নয়। তারা সনদের আইনি ভিত্তি চায়। তাদের ভাষ্য, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে এর অধীনে নির্বাচন হতে হবে। গতকাল এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন একই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
যেসব অঙ্গীকার রয়েছে
সনদে বলা হয়েছে কী কী সংস্কার হবে। সংলাপে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দল এতে সই করে, সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে। অঙ্গীকারনামার শুরুতে অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গ্রহণ করা হয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ওই সময় পর্যন্ত সংবিধান না থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মধ্যবর্তী সময়ের সব কাজকে আইনি ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়।
একইভাবে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া আইনে না হলেও রাজনৈতিক অঙ্গীকারে বৈধতা দেওয়া হয়। এ ধরনের বৈধতা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক কনভেনশন এবং গণতন্ত্রকে সংহত করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষাকে একইভাবে বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সনদের খসড়ায়।
৮টি অঙ্গীকার
সনদের খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নে আট দফা অঙ্গীকারনামা রাখা হয়েছে। অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’–এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
২. এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে বিধায় এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে, সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
৩. এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
৪. সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
৫. সনদে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা।
৬. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৭. রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারসমূহকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
৮. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এর যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
খুলনা গেজেট/এইচ