“আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই”, এই স্লোগান নিয়েই গত বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। ঘটনা পরম্পরায় যা গড়ায় সরকার পতনের আন্দোলনে।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের দীর্ঘ শাসনের পতন হয়। ছাত্র প্রতিনিধিসহ শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। তারও হতে চলেছে বর্ষপূর্তি।
কিন্তু প্রভাব বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি, দুর্নীতি, চাকরি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়গুলো বন্ধ হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ বেড়েছে।
এমনকি আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরাই জুলাইকে ‘মানিমেকিং মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ উঠছে।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনিক কাঠামোতে আদৌ কতটা পরিবর্তন হলো?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার কিংবা জুলাই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউই বৈষম্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখেননি। ফলে অপরিবর্তিত কাঠামোতে বহাল রয়েছে পুরনো ব্যবস্থা।
‘আমূল কোনো পরিবর্তন নেই’
গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের আটই অগাস্ট শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এর তিনদিন পর প্রটোকল বিধির তোয়াক্কা না করেই যানজটের মধ্যে আটকে থাকেন তিনি, যা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে বেশ প্রশংসা কুড়ায় অন্তর্বর্তী সরকার।
অনেকেই আশা করেন, সেখান থেকেই শুরু হবে পরিবর্তনের। যদিও সে আশা পূরণ হয়নি।
হরহামেশাই এখন যানজটে বসে থাকেন জনসাধারণ, আর বিশেষ প্রটোকল নিয়ে পাশ দিয়েই চলে যেতে দেখা যায় ভিআইপিদের।
এমন আরেকটি উদাহরণ পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রাথমিকভাবে পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি কমার আলোচনা শোনা গেলেও, এক বছর পরও আঞ্চলিক কার্যালয়ে হয়নি তেমন কোনো পরিবর্তন।
প্রায় সাত লাখের বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স আটকে আছে বিআরটিএতে। একই চিত্র বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে এবং বিমানবন্দরে, প্রশাসনেও। রয়ে গেছে পুরনো ‘স্যার’ কালচার।
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আসা উপলক্ষে রাতারাতি মাঠের মধ্যে সড়ক নির্মাণ করে শিক্ষার্থীদের দুই পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা কিংবা দুর্ব্যবহারের মতো বিতর্কিত নানা কার্যকলাপ কয়েকদিন পরপরই ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অভ্যুত্থানের পরও প্রশাসনে আমূল কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুরনো আমলাতান্ত্রিকতা চলমান থাকার কারণে বিষয়গুলো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
এ নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মাহা মির্জা বলেন, “অভ্যুত্থানের পর আমলারা বদলে গেছেন তেমনতো না। সেই আওয়ামী আমলের যেই আমলাতন্ত্র, যেটা নিপীড়নমূলক আমলাতন্ত্র, যে আমলারা মানুষকে মানুষ মনে করতেন না, যে কারণে আমাদের এখানে এরকম অশ্লীল একটা ভিআইপি কালচার তৈরি হয়েছিল-সেই মানুষগুলোইতো আসলে তাদের পদগুলোতে রয়ে গেছে”।
স্বৈরশাসনের আগে থেকেই বাংলাদেশে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি মিলিয়ে তৈরি হওয়া কাঠামো সরকার বদলের মধ্য দিয়ে রাতারাতি পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে করেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস।
“নতুন সরকারের দিক থেকে ইনএফিসিয়েন্সি ছিল, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি। ফলে নানা কিছুর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সেভাবে পাকাপোক্তভাবে দেখা যায়নি”, বলেন তিনি।
পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
উদাহরণ দিয়ে বলেন, সব উপদেষ্টারা মন্ত্রিপাড়ায় থাকা সত্ত্বেও সচিবালয়ে যাতায়াতে আগের মতোই সবাই প্রটোকলসহ ব্যক্তিগত বাহন ব্যবহার করেন।
একে ‘অপচয়’ উল্লেখ করে মি. আহমদ বলেন, “আমিতো তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখি না”।
“বহু বছরের জঞ্জাল, এটাতো এক বছরে পরিবর্তন হবে না”, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘বাঁচার আন্দোলন থেকে বেচার আন্দোলন’
আগের মতোই এখনও এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল পাঠানো, বদলি কিংবা নিয়োগে চলছে তদবির বাণিজ্য। উঠছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ।
আর তাতে কেবল প্রশাসন নয়, সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে খোদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই।
গত আটাশে জুলাই প্ল্যাটফর্মটির সাবেক সমন্বয়ক ও মুখপাত্র উমামা ফাতেমা নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে অভিযোগ করেন যে জুলাইকে ‘মানিমেকিং মেশিনে’ পরিণত করা হয়েছে।
এর কয়েকদিন আগেই ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে গুলশানে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আটক হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদ।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সাথে তার সখ্যতা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।
অবশ্য যে বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে আন্দোলন হয়েছে তাদের মধ্যেই সবার আগে বৈষম্য দেখা গিয়েছিল বলে অভিযোগ করছেন আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক হাসিবুর ইসলাম নাসিফ।
“বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পাঁচ অগাস্টের পরে কোটার আঁতুড়ঘর হয়ে গিয়েছিল। ভাই, বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র ইত্যাদি কোটায় মানুষজনকে বিভিন্ন কমিটি, পজিশন দেয়া হচ্ছিলো। আর যারা তথাকথিত ফেইস হয়েছিল তারা ব্যতীত বাকি কারো কথা কোরামে কখনোই শোনা হতো না”, বলেন হাসিবুর ইসলাম নাসিফ।
সেপ্টেম্বরের দিকে সরকারি খরচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভাগীয় সফর হয়েছিল বলেও অভিযোগ তোলেন মি. নাসিফ।
“আমরা রাষ্ট্রের কোনো এজেন্ট হিসেবে ওখানে যাইনি। আমরা রাষ্ট্রের কোনো অংশও তখন ছিলাম না। কিন্তু রাষ্ট্র যখন আমাদের খরচ বহন করছে সেটা পুরোপুরি আনইথিক্যাল, ইমমোরাল এবং “অবৈধ”, বলেন তিনি।
অনুশোচনাবোধ থেকে পরবর্তী সময়ে পদ ছেড়ে প্ল্যাটফর্মটির সাথে দূরত্ব তৈরি করেন বলেও জানান তিনি।
জুলাই “বাঁচার আন্দোলন থেকে বেচার আন্দোলন” হয়ে গেছে বলে মনে করছেন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু।
“প্রত্যেকটা জায়গায় জুলাইকে নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু জুলাই নিয়ে জনগণের মূল আকাঙ্ক্ষার জায়গা যেটা ছিল সেটা আসলে কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হয়নি”।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী নানা বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হলেও আসলে তা দূর হয়নি। বরং ছাত্র নেতৃত্বের যারা সরকারে গেছেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধেও।
কুমিল্লার মুরাদনগরে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবার বিরুদ্ধে।
কয়েক মাস আগে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে আসিফ মাহমুদসহ আরও এক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে এনসিপি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয় দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে।
নিজ জেলায় শত শত গাড়িবহর নিয়ে মিছিল করার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন এনসিপি নেতা সারজিস আলম।
আর মব তৈরির চেষ্টা করাদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনায় শোকজ করা হয়েছিল হান্নান মাসউদকে।
অধ্যাপক ফেরদৌসের মতে, নতুন ব্যবস্থা চাইলেও পুরনো পথেই হাঁটছে সবাই।
বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি যারা দিয়ে আসছেন, তাদের দল এনসিপির প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক ফেরদৌস বলেন, “তারা আসলে শিখেছে কোথা থেকে, তাদের গ্রুমিং হয়েছে কোথায়, তারা বেড়ে উঠেছে কোথায়? তারাও রাজনৈতিক নেতা হওয়া বলতে কী বোঝায়? এলাকায় যাওয়া বলতে কী বোঝায়? তারা যা দেখেছে, তা-ই করছে। ফলে বাস্তবে কোনো বড়সড় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি না”।
নারীর প্রতি বৈষম্য এখন বড় ইস্যু
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।
২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করার প্রতিবাদে রাত্রিকালীন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রোকেয়া হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা, যা অনেকের মতেই আন্দোলনটির গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল।
অথচ এক বছর পরও নারী হলগুলোতে রয়ে গেছে বৈষম্যমূলক নানা নিয়ম। এছাড়াও পোশাক থেকে পেশা কিংবা রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে নারীরাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যা সমাজে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এনিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সহ-সমন্বয়ক মাইশা মালিহা বলছেন, ‘অধিকারের বৈষম্যে’ খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
“আন্দোলনটার পর আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এই ব্যাপারগুলো দূর হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের মধ্যে এই সংস্কারটা আসবে। কিন্তু আমরা বাস্তবতায় দেখছি এরকম কিছু হচ্ছে না। বরং নারী হেনস্তাকারীদেরকেই ফুলের মালা দিয়ে সমাজে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের শাস্তি হচ্ছে না”, বলেন তিনি।
মাহা মির্জার মতে, প্রচুর জনসমর্থন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি তারা। যার কারণে বছর পেরোলেও হয়নি কোনো পরিবর্তন।
“আমি দোষ দেবো সরকারকে। সরকারের যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল ঠিক সময়ে তারা সেই সময়মতো পদক্ষেপগুলো নিতে পারেনি। এই সামাজিক সমস্যাগুলোকে ডিল করার জন্যে যে দৃঢ়তা, যে শক্ত অবস্থানটা তাদের দেখানোর কথা ছিল তারা সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে”, বলেন মিজ মির্জা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।
খুলনা গেজেট/এনএম