বাংলাদেশের প্রচলিত যতগুলো প্রবাদ জনপ্রিয় তার মধ্যে একটা হলো ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’ যদিও কথাটার ব্যাপ্তি শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং একটা সার্বজনীনতা পেয়েছে। সারা বিশ্বের চোর ও তার মায়েদের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখুন তাকিয়ে ইসরায়েলের দিকে।
ইসরায়েল নামের দেশটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না বিশ্ব মানচিত্রে। ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। তবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপরই শুরু হয় খেলা।
ইতিহাস নিয়ে লেখার এই এক ঝামেলা, গল্প যে কখন কোনদিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। আবার মূল গল্পে ফিরে যাওয়াও বেশ চ্যালেঞ্জিং। তো যেখানে ছিলাম, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরবরা আর সংখ্যালঘু ছিল ইহুদিরা। সংখ্যায় অনেক কম। আর আজ যদি দেখেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৫১ লাখ আর ইসরায়েলের জনসংখ্যা ৯২ লাখ।
একটা সময় ছিল যখন ইহুদিরা ছিল এই পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত যাযাবর জাতি। অস্তিত্ব রক্ষায় তারা বারবার বিতাড়িত হয়েছে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। যদিও এদের আদি নিবাস ছিল ফিলিস্তিন-লেবানন-জর্ডান-সিরিয়া অঞ্চল, তবে এক সময় তারা জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছিল এতোটাই ধূর্ত যে ইউরোপ তাদের দেশে তাদেরকে স্থান না দিয়ে তাদের স্থান করে দেয় মধ্যপ্রাচ্যে। আর ইহুদিদের চরিত্র তো প্রকাশ পেয়েছে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটিকার শাইলক চরিত্রের মাধ্যমে।
১৮৯৬ সালে একজন ইহুদি ধর্মীয় নেতা ড. থিওডোর হাজরেল ইহুদিদের একটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্য প্রথম দাবি জানান। আর তার সঙ্গে হাত মেলায় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের সফলতার পেছনে ছিল ইহুদিদের তৈরি আসিটোন। তাই ব্রিটেনও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইসরায়েলের কাঁধে হাত রাখে।
১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ছিল ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। তখনই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সাহায্য করার। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে ৬৭ শব্দের একটি চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। যা ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ নামে পরিচিত।
সংকট নতুন রূপ নেয় যখন ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। যুক্তি ছিল ইহুদিরা মনে করে এই অঞ্চল তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ। কিন্তু আরবরাও দাবি করে এই ভূমি তাদের এবং ইহুদিদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার তারা বিরোধিতা করে।
কার কথা কে শোনে? সব বিরোধীতা উপেক্ষা করে এবং নিপীড়নের শিকার হয়ে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা যেতে থাকে ফিলিস্তিনে। বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। সংখ্যালঘুরা আন্তর্জাতিক শক্তির মদদে তাদের অবস্থান শক্ত করতে শুরু করে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুরো এলাকার চিত্র বদলাতে যে চেষ্টা শুরু করে ইহুদিরা তা দিন দিন বিশ্ববাসীর কাছে পরিস্কার হতে শুরু করে।
তবে তা গতি পায় যখন হিটলার ইহুদি নিধনযজ্ঞে নামে। তখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনকে ঘিরে তাদের নতুন আবাস গড়ে তুলতে মনযোগী হয়। আর ততই বাড়তে থাকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। হিটলারের চোখে ইহুদি সমস্যা ছিল তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তিনি প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি নিধন করেন যা তৎকালীন ইহুদিদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ ভাগ।
ইহুদিদের নিয়ে হিটলারের এক মন্তব্য বোধ করি আজও সমানভাবে প্রযোজ্য।
‘আমি চাইলে সব ইহুদিদের হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু কিছু ইহুদি বাঁচিয়ে রেখেছি, এই জন্যে যে, যাতে পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে, আমি কেন ইহুদি হত্যায় মেতেছিলাম।’
এবার ভূমিকায় জাতিসংঘ। সংস্থাটি এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। একই সঙ্গে এটাও ঠিক করা হয় যে জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছাড়ে।
এরপরই আসে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা। শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নাগরিকদের এক ধরনের পরাজয় ঘটে কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়। এর বড় একটা কারণ ছিল ইহুদিদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব। আর ওই দিকে আরব বিশ্ব ছিল নেতৃত্ব শূন্য।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। এক সঙ্গে পাঁচটি আরব দেশ — মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া–ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। কিন্তু অবিশ্বাস আর নেতৃত্বের অদূরদর্শীতায় আরব দেশগুলো পরাজিত হয়।
সেই যে যুদ্ধ শুরু তা আর কোনো দিনই শেষ হয়নি বরং থেমে থেমে চলতে থাকে। ফিলিস্তিনিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে আর বাড়তে থাকে ইসরায়েলের আধিপত্য। আজকে পশ্চিমা বিশ্ব ও আরব বিশ্বের কিছু কিছু রাষ্ট্রের মদদে ফিলিস্তান নাস্তানাবুদ।
অবৈধ ইসরায়েল হয়ে ওঠে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর একটি। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে তারা হয়ে ওঠে অজেয়। বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েল হয়ে ওঠে দখলদার চরিত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ। পশ্চিমা বিশ্ব বা জাতিসংঘের যে নগ্ন ভুমিকা তা বিশ্ববাসীর কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। মানে অনেকটা গ্রাম্য মোড়লের মতো যার কাছে আইন কানুন তুচ্ছ। জোর যার মুল্লুক তার।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী মানুষেরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে যখনই সোচ্চার তখনই রকেট হামলায় ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণকে। তবে মজার কথা হলো এই যে, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকে যখন বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠন তখন ইসরায়েলের লিকুদ পার্টি যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে গণহত্যা চালাচ্ছে তাদেরকে কিন্তু দোষারোপ করা হচ্ছে না বা সন্ত্রাসী তকমা দেয়া হচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্ব যারা মানবাধিকার রক্ষায় সব সময় সোচ্চার তারা আজ মূক ও বধির।
মাহাথির মোহাম্মাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসের মূলেই হচ্ছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে, সেখানের ৯০ ভাগ আরব জনগণকে উৎখাত করে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হচ্ছে আধুনিক সন্ত্রাসবাদের শুরু। ইসরায়েলকে থামাতে না পারলে সারা দুনিয়াকে সন্ত্রাস মুক্ত করা যাবে না। কারণ ইসরায়েল হচ্ছে সারা দুনিয়ার সন্ত্রাসের মূল উৎস।’
মাহাথিরের কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয় তবে সেটা ইসরায়েলকে বাদ দিয়ে হবে না বরং ইসরায়েল থেকেই শুরু করতে হবে। আর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা মানে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
সকল মুক্তিকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
তবে এই যুগে এসে যুদ্ধ শুধু ক্ষয়ক্ষতিই বাড়াবে কিন্তু সমাধানের পথে নিয়ে যেতে পারবে না। আমরা তো আফগানিস্তানকে দেখলাম। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়বে বলে ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সন্ত্রাসবাদ কি থামাতে পেরেছে?
ইসরায়েলের এই আগ্রাসন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমস্ত বিবেকবান মানুষকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলছে এবং তুলবে। আর তা আখেরে ইসরায়েল ও তার দোসরদের জন্য এক বিশাল বিপদ নিয়ে আসবে।
শেষ করতে চাই যে ইসরায়েল- ফিলিস্তিন ইস্যুকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিশাল ভুল হবে। দেখতে হবে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। মনে রাখতে হবে মানবিক আবেদনের কাছে রকেট হামলা বা এয়ার স্ট্রাইক নিতান্তই তুচ্ছ। লড়াই করা শিখে গেলে তা কিন্তু বন্ধ হবে না।
ইসরায়েল ও তার দোসরদের কটাক্ষ করে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে টুইটারে মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, ‘তোমরা আমাদের পানি কেড়ে নিয়েছ, জলপাই গাছ ধ্বংস করেছ, আমাদের কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছ, আমাদের ভূমি দখল করেছ, আমার বাবাকে কারাবন্দি, আর মাকে হত্যা করেছ, বোমা ফেলে আমাদের দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছ, আমাদের সবাইকে ক্ষুধার্ত রেখেছ, আমাদের সবাইকে অসম্মান করেছ। এসব সত্ত্বেও আমাদের দোষারোপ করে বলছ, আমরা পাল্টা রকেট নিক্ষেপ করেছি।’
(লেখক : মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা, সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার)
খুলনা গেজেট/এমএইচবি