খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  হাইব্রিড মডেলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, রাজি পাকিস্তান; ভারতের ম্যাচ দুবাইয়ে : বিসিবিআই সূত্র
  গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত, গুম কমিশনের সুপারিশে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে

বিধানসভা নির্বাচন : বাংলার বিধান

মজিবুর রহমান, মু‌র্শিদাবাদ

পশ্চিমবঙ্গে সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে চৌত্রিশ দিন ধরে আট দফায় ভোট গ্ৰহণের পর সাঁইত্রিশ দিনের মাথায় ২ মে সত‍্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিবসে প্রকাশিত ফলাফল ‘মহানগর’-এর সকলকে অবাক করে দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী, সংবাদমাধ‍্যম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কেউই সম্ভাব্য ফলাফল সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। ‘ঘরে বাইরে’র কোনও সংস্থার ভোট-পূর্ববর্তী কিংবা ভোট-পরবর্তী সমীক্ষার পূর্বাভাস মেলেনি। সম্পূর্ণ অপ্রত‍্যাশিত ও অভাবনীয় ফল হয়েছে। তৃণমূলের দুই-তৃতীয়াংশ তথা দুশোর বেশি আসন জেতা, বিজেপির আশির কমে আটকে যাওয়া, বাম-কংগ্রেসের শূন্য হওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারেনি। তবে বর্তমান ও অতীতের কিছু বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বাংলা তথা বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজ‍্যে সরকার গঠনের প্রশ্নে অত‍্যন্ত পরিষ্কার রায় দেয়। প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে জনগণের সমর্থন দুটো দল অথবা জোটের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।সেখানে কোনও তৃতীয় দল বা জোটের স্থান থাকে না। প্রথম দল/জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। দ্বিতীয় দল/জোট প্রয়োজনীয় বিধায়ক সংখ্যা নিয়ে বিরোধী আসনে বসে। তৃতীয় দল/জোটের আসন সংখ্যা সাধারণত এক অঙ্কেই সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন, ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজ‍্যে যখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল তখন জাতীয় কংগ্রেস অথবা জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের জোট বিরোধী আসন অলংকৃত করেছে, বিজেপি ধর্তব‍্যের মধ্যে আসেনি। ২০১১ সালে মমতা ব‍্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেসের জোট সরকার গঠিত হয়। বামফ্রন্ট বিরোধী আসনে বসে কিন্তু বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা এক অঙ্কেই থাকে। ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ভোটে লড়ে দুই শতাধিক আসন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। বাম-কংগ্রেস জোট ৭০+ বিধায়ক নিয়ে বিরোধী আসনে বসে এবং বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা যথারীতি এক অঙ্কেই ছিল। ২০২১ সালে বিধানসভায় মমতা ব‍্যানার্জি তথা তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান প্রায় একই থাকছে, শুধু প্রধান বিরোধী দলের বদল ঘটছে। এবার ৭০+ আসন নিয়ে বিজেপি সেই জায়গাটা দখল করছে আর বাম-কংগ্রেস-আই এস এফ নিয়ে গঠিত সংযুক্ত মোচা মাত্র একজন বিধায়কের জোটে পরিণত হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বরাবর স্থিতিশীল সরকার গঠনের পক্ষে রায় দেয়। সরকার গঠনে কখনও ত্রিশঙ্কু অবস্থা সৃষ্টি হয় না। এর ফলশ্রুতি হল প্রতিটি সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে (১৯৬৭ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত তিন-চারটি সরকারের পতন ব‍্যতিক্রমী ঘটনা ছিল)। মাঝ পথে সরকারের পতন ঘটে কখনও অন্তর্বর্তী নির্বাচন করার দরকার হয় না। পশ্চিমবঙ্গে মুখ‍্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কখনও কোনও অনিশ্চয়তা অথবা অচলাবস্থা তৈরি হতে দেখা যায় না। বিধানসভার ভোট প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকেই বোঝা যায় কোন দল/জোট ক্ষমতায় এলে কে মুখ‍্যমন্ত্রী হবেন। যেমন, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট জ‍্যোতি বসুকে সামনে রেখে জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ে জয়লাভ করে এবং তিনিই মুখ‍্যমন্ত্রী হন। জ‍্যোতিবাবু মুখ‍্যমন্ত্রী থাকতে থাকতেই বামফ্রন্ট সরকারের পরবর্তী মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তুলে ধরা হয়। বামফ্রন্ট শাসনের অবসানের পর মমতা ব‍্যানার্জির মুখ‍্যমন্ত্রী হওয়ার প্রশ্নেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেজন্য ২০১১ সালের সাধারণ বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেও তৃণমূল কংগ্রেস-জাতীয় কংগ্রেসের জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তিনিই মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্ৰহণ করেন। ২০১৬ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট কিংবা বিজেপি তাদের কোনও নেতাকে মুখ‍্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি, তাদের ফলও ভালো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে খুব সহজে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া ওঠে না।

শাসকদলকে পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়। তাড়াহুড়ো করে কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় না। বদলের জন্য বদল এই রাজ‍্যের মানুষের না-পসন্দ। রাজ‍্যবাসী বিরোধী দলের প্রতিশ্রুতির চেয়ে শাসকদলের কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিয়ে খুশি থাকতে চায়। এজন্য স্বাধীনতার পর দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের পর মানুষ পর পর সাতবার বামফ্রন্টকে সরকার গঠনের সুযোগ দিয়েছে। বামফ্রন্টের বিদায়ের পর এখন আবার মমতা ব‍্যানার্জির সরকারের হ‍্যাট্রিক হয়ে গেল। রাজ‍্যে চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা না দিলে অথবা প্রশাসনিক ব‍্যবস্থা ভেঙে না পড়লে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সরকার পরিবর্তন করতে চায় না।

সরকার একটু কম কাজ করলেও চলবে কিন্তু অত‍্যন্ত আপত্তিকর অপকর্ম যেন না করে, এই হল মানুষের চাহিদা। সাতের দশকে মুখ‍্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে বিরোধীদের ওপর দমন পীড়ন করা হয় এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। গোটা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে রাজ‍্যবাসী ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৩০+ আসন নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পুনরায় সরকার গঠন করেন। কিন্তু ২০০৭ সালের মাচ মাসেই নন্দীগ্ৰামে পুলিশ-গ্ৰামবাসীর সংঘর্ষে চৌদ্দ জন আন্দোলনকারীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে যায়।

ওই ঘটনার পর থেকে রাজ‍্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। খুন-জখম নিত‍্য দিনের ঘটনায় পরিণত হয়। রাজ‍্যের বেশকিছু এলাকা মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠে। রাজ‍্যে একটা নৈরাজ‍্যের পরিবেশ তৈরি হয়। পরিস্থিতির উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে রীতিমত অসহায়বোধ করছিলেন। বামফ্রন্টের মধ‍্যেও তীব্র কলহ তৈরি হয়। সরকার সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের আস্থা হারায়। বামফ্রন্ট জমানার অবসান অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০১১ সাল থেকে দশ বছর ধরে মমতা ব‍্যানার্জি মুখ‍্যমন্ত্রী আছেন। দল ও সরকারে এখনও তিনিই শেষ কথা। সবকিছুর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ভালমন্দ মিশিয়ে এই সময়ে যে সব কাজকর্ম হয়েছে তাতে রাজ‍্যবাসী মোটের ওপর খুশি। এজন্য রাজ‍্যের নির্বাচকমণ্ডলী ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল সরকারকে বিদায় জানানোর মতো কোনও গুরুতর কারণ দেখেনি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!