আজ পহেলা বৈশাখ। স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৮। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যোগ হলো নতুন বছর। ডানা ঝাপটানো পাখির মতো কাঁপানো সময়ে এলো এই বৈশাখ। প্রতি মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ আর বিষাদে। আনন্দের সময় কেড়ে নিচ্ছে করোনা সংক্রমণ। এই বিষাদ ছড়ানো সময়কে দূর করতেই হবে। আনন্দগান শোনা আর সৌরভ ছড়ানোর দিন ফিরিয়ে আনতে হবে। রুদ্ররূপ, কালবৈশাখীর ঝড় পাল্টে দিতে পারে সব জীর্ণতা, দীনতাকে। নতুন বাংলাবর্ষ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ এই শুভবার্তাই দিতে চায়।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি।
পহেলা বৈশাখ এলেই পরস্পরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন, ব্যবসায়ীর অর্থ পরিশোধ করা, হালখাতা খোলার সেই চিরায়ত দৃশ্যগুলো ঘুরপাক খায়। বৈশাখ মানে গ্রামে ও শহরে মেলায় মানুষের ভিড়। বৈশাখী মেলার অন্যতম অনুষঙ্গ পুতুল নাচ, হাতি-ঘোড়ার সার্কাস, বায়স্কোপ। কোথাও আবার দেখা মেলে লাঠিখেলা, পালাগান, কীর্তনের আসর, নৌকা-বাইচ বা মাঠে কুস্তিখেলার দৃশ্য। করোনার জন্য এই দৃশ্যগুলো গত বছর দেখা যায়নি। এবারও কোনো আয়োজনের সুযোগ নেই।
করোনা সংক্রমণ এড়াতে এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সশরীরে কোনো মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়ার পর সীমিত আকারে প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে চারুকলা কর্তৃপক্ষ। ১৪ এপ্রিল সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রা করবে কর্তৃপক্ষ। সেখানে সাধারণ জনগণ উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
ইলিশ ও পান্তাভাত না হলে বাংলা নববর্ষ পালন যেন পূর্ণতা পায় না। এজন্য অবশ্য ইলিশ বাজারে ঠিকঠাক উঠেছিল, ক্রেতা ছিল কম। হতাশা ও বিষাদকে বিদায় জানিয়ে আগামীর উজ্জ্বলতা ছড়াতে এসেছে বৈশাখ। একই সঙ্গে লাল ও শুভ্রতার নিপুণ সৌন্দর্য বৈশাখের শুরুর দিনে ভরাবে মন।
অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। বাঙালিরা করোনা মহামারি থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই নতুন বছরকে বরণ করবে। তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা নেই।
আজ ভোরের আলো নিয়ে আসবে নতুন স্বপ্ন, আশা ও সম্ভাবনাকে। সারা দেশে আজ থেকে আগামী ২১ এপ্রিল পর্যন্ত চলাচলে, অনুষ্ঠানে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে গত বছরের মতো এবারও বর্ষবরণ উৎসব থাকছে বিধিনিষেধের আওতায়। মুক্তিযুদ্ধের পর গত বছর নববর্ষের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান হয়নি। ওই ধারাবাহিকতায় এবছরও থাকছে না ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান।
নববর্ষের সকালে সংগঠনের সভাপতি সনজীদা খাতুনের ‘কথন’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হবে। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতেও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার হবে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠান করবে।
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চন্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়ার পর প্রথমদিকে ফসলি সন নামে পরিচিত হলেও পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
১৯৮৭ সালে শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম ও হিরণ্ময় চন্দের উদ্যোগে হাতি-ঘোড়া, পাখপাখালির আদলে তৈরি পুতুল দিয়ে যশোরে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে ১৯৮৯ সালের দিকে শোভাযাত্রাটি চালু হয়। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।