সারা ভারতে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, আসাম, তামিলনাড়ু ও পদুচেরি (সাবেক পণ্ডিচেরি)। এদের মধ্যে পদুচেরি হল কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। কিন্তু সমগ্র ভারতের মধ্যে সবার নজর পশ্চিমবঙ্গের দিকে। আর পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসনটি সবচেয়ে নজরকাড়া কেন্দ্র। এই নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের প্রার্থী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সুপ্রীমো মমতা ব্যানার্জি। বিপরীতে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এককালের তৃণমূলের যুবনেতা রাজ্যের সাবেক পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে এখানে বাম-কংগ্রেস-আই এস এফের সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপি আই এমের যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তিনজনই ব্রাহ্মণ সন্তান। শুভেন্দু এখন বিজেপির নেতা।
একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৫২ সাল থেকে এই আসন বেশির ভাগ সময় কমিউনিস্ট পার্টির দখলে ছিল।জমি-আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রভূমি এই এলাকা ছিল লাল দুর্গ। ২০০৬-০৭ সালে শিল্পের জন্য জমি হারানোর ভয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে দুই স্হানে জমি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তৃণমূলের নেতৃত্বে তার মধ্যে বহুল পরিচিত এলাকা হল হুগলির সিঙ্গুর আর পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম। আর সেই নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন যার হাত ধরে প্রসারিত হয়েছিল তার নাম শুভেন্দু অধিকারী। বলা ভালো অধিকারী পরিবার। এদেরকে বলা হয় কাঁথির বেতাজ সম্রাট। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের স্বর্ণযুগেও শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী কাঁথি বিধানসভা ও পুরসভা দখলে রেখেছিলেন।
শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী, দিব্যেন্দু অধিকারী ও সৌমেন্দ্রনাথ অধিকারী–চার জন প্রতিনিধি। এদের মধ্যে শুভেন্দু ও সৌমেন্দ্র তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে এসেছেন। আর শিশির অধিকারী ও দিব্যেন্দু অধিকারী কার্যত ব্রাকেট বন্দী তৃণমূল, মানসিকভাবে বিজেপি।
২০০৮ সালে সিপি আই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের ঘুষ খাওয়ার অভিযোগে বিধায়ক পদ বাতিল হলে সেখানকার উপনির্বাচনে জয়ী হন জমি আন্দোলনে সন্তান হারা ফিরোজা বিবি। নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন বা সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন ২০১১ সালে তৃণমূলের ক্ষমতায়নকে সুবিধা করে দেয়।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তমলুক লোকসভায় শুভেন্দু অধিকারী সিপিআইএমের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী লক্ষণ শেঠকে হারান। ছাত্র আন্দোলন থেকে জমি আন্দোলনে একটা জনপ্রিয় জায়গায় চলে আসেন শুভেন্দু অধিকারী। সেই শুভেন্দু এখন বিজেপির প্রার্থী নন্দীগ্রামে। একজন নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র। আরেকজন হেভিওয়েট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এখন আর মানুষ জোটের প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জিকে সেরকম আমল দিতে না-রাজ।
নন্দীগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য প্রান্তের মতোই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করছেন। আবার অনেক তৃণমূল ব্রাকেট বন্দী হয়ে আছেন। তারা তৃণমূলে থেকে কতখানি অন্তর্ঘাত করবেন তাও কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন। বিজেপি আজ ভারতে ক্ষমতাসীন। তার পয়সাবল ও রেজিমেন্টেড কায়দা তৃণমূলকে অনেকটাই বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে।আবার মমতার আহত হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই তার রাজনৈতিক জীবনের আরেক নাটক বলে মনে করছেন। আজ যিনি নন্দীগ্রামের বিজেপি প্রার্থী সেই শুভেন্দু অধিকারীর অধিকারী পরিবারের লোকবল, অর্থবল, প্রভাব কিন্তু যথেষ্ট। এলাকার কলকব্জা অধিকারী পরিবারের রপ্ত।
অনেকেই বলবেন নন্দীগ্রামে মোট ভোটার আড়াই লাখের কিছু বেশি। এই ভোটারের মধ্যে মুসলিম ২৩ শতাংশ । অর্থাৎ ৬৬ হাজার। এই ভোট একটা ম্যাজিক ফিগার। রাজনীতির ক্ষেত্রে অধিকারী পরিবার এই ভোটেও থাবা বসাবে। আর এখানে বিজেপি অমিত শাহ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বলিউড তারকা মিঠুন চক্রবর্তী সহ সবাইকে আনবেন। নন্দীগ্রামে দুলাখ হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে মেরুকরণ হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। এদিন শুভেন্দুর সঙ্গে যারা জমি আন্দোলন করেছেন, দু-একজন বাদ দিলে সেই সমস্ত মুসলিম মুখগুলি এলাকা থেকে সরে গিয়ে শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মুসলিম ভোটেও শুভেন্দু থাবা বসাবেন। সবমিলিয়ে নন্দীগ্রামে লড়াই ভূমিপুত্র শুভেন্দু বনাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আবেগ। তবে চূড়ান্ত ফল দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেই ২ মে পর্যন্ত।
খুলনা গেজেট/এনএম