বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দল বদলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৭ সালে তখনকার যুব কংগ্রেসের নেতা সঞ্জয় গান্ধীর দাপট ও একচ্ছত্রাধিপত্য কংগ্রেসকে নানা ভাগে বিভক্ত করে। হুমায়ূন কবীর বা অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলা কংগ্রেস। আবার সারা ভারতে দেবরাজ আর্সের নেতৃত্বে গঠিত হয় আর্স কংগেস বা কংগেস (ইউ)। এসমা, নাসা, মেসার মতো কালাকানুন চালু, সর্বোপরি ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা চালুর ফলে জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জনতা দল কংগ্রেস বিরোধী একটা ফ্রন্ট তৈরি করল। কংগ্রেসের যারা সঞ্জয় গান্ধী বা ইন্দিরা গান্ধীর কালাকানুন বা জরুরি অবস্থা মানেননি তারাই জনতা দলের সঙ্গে চলে গেল।
১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয় কংগ্রেসের বা ইন্দিরা কংগ্রেসের শুধু ভরাডুবিই হয়নি, ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী পরাজিত হন। ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের অলিতে গলিতে একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল যে, গাই- বাছুর দুটোই হেরেছে। তখন কংগ্রেসের প্রতীক ছিল গাইবাছুর। মানুষ ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীর হারাটাকে এইভাবেই ব্যঙ্গ করতেন। কিন্তু আমাদের আরো মনে রাখতে হবে ইন্দিরা গান্ধীর মতো একজন ডায়ানেমিক নেত্রীর পতনটা যেমন সত্য, ১৯৮০ সালে তার ওভারকাম বা সাফল্যটা তেমনি সত্য। রাজকীয়ভাবেই তিনি সেদিন দিল্লির মসনদে ফিরে এসেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের ঘোড়া কেনা-বেচা বা দল বদলের ঘটনার মধ্যে কিছুটা মিল পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালের মতোই। ২০১৪ সালের রাজ্যসভার নির্বাচনে তৃণমূলের একজন প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বাম ও কংগ্রেসের পাঁচ বিধায়ককে সেদিন তৃণমূল কিনেছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঘোড়া কেনা-বেচার সেই শুরু। আর যার হাত দিয়ে হয়েছিল তিনি এখন বিজেপিতে। তিনি হলেন সেই মুকুল রায় যিনি ২০১৭ সালে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেন। মুকুল রায় ছিলেন তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সেই ১৯৯৮ সাল থেকে।
তবে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দলবদলের কারণ প্রধানত তিন চারটি। প্রথমটি হল পশ্চিমবঙ্গে সারদা-রোজভ্যালিসহ বিভিন্ন চিটফাণ্ড প্রতারণায় কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। আর এই চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংদদের নাম উঠে এসেছে। তাদের অনেকেই জেল খেটেছেন, অনেকেই অভিযুক্ত, অনেকের মামলা চলছে। তাই অনেকেই ওই চিটফাণ্ড থেকে বাঁচার জন্য দলবদল করেছেন। আমরা এইসব করে সবটাই কালীঘাটে পাঠাব। আর নেত্রী ধরি মাছ না ছুঁই পানি করবেন, তা হতে পারে না। তাই নিজেদের বাঁচতে অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত তৃণমূল ক্ষমতায় এসে একের পর বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা করল। বিশেষ করে সিপিআইএম সহ বাম দল ও কংগ্রেসকে ভাঙবার চেষ্টা করল, আর তাদের দলীয় দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দিল। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের মননোয়ন পর্যন্ত দিতে দেয়নি। এর ফলে স্হানীয় স্তরের মানুষজন ভাবল পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূলের হাত থেকে রেহাই পেতে কেন্দ্রে বা দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপি দল করি। সাধারণ সমর্থকরা এই কারণে বিজেপিতে গিয়ে সামিল হলেন।
তৃণমূলের একাংশ সৎ ও যথেষ্ট বিনয়ী। তারা এলাকায় কাজ করতে পারছিলেন না মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির জন্য। তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতা- মন্ত্রী-সাংসদ ভাবতে লাগল যে মমতা ব্যানার্জিকে দেখে আমরা দলে এসেছিলাম, তাতে আর মমতা ব্যানার্জির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, অভিষেকই শেষ কথা। এটা আর দল নয়, এটা একটা প্রাইভেট কোম্পানী লিমিটেড। তাদের মনে হয়েছে অভিষেক, কালকের ছেলে। অভিষেক দলের সিনিয়রদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। ১৯৭৭ সালে সঞ্জয় গান্ধী যদি ইন্দিরা গান্ধীর পতনের কারণ ও জাতীয় কংগ্রেসের পতনের জন্য দায়ি হয়, তাহলে এই ২০২১ সালে তৃণমূলের পতনের জন্য দায়ি থাকবেন অভিষেক ব্যানার্জি বলে মনে করছেন খোদ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পর্যবক্ষেকরাই।
পৃথিবীর ইতিহাস কিন্তু বলছে শাসকের পতন বা শাসকদলের পতনের জন্য প্রধান দায়ি সেই দলের নেতা বা নেত্রীর আত্মীয় স্বজন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভারতের শাসক দলের অর্থের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছেন। মুকুল রায়ের পরিবার বা শুভেন্দু অধিকারীর পরিরার কংগ্রেস-তৃণমূলের কাছে অনেক খেয়ে এবার তারা বিজেপি নামক শিকড়ে ভিড়েছে। রাজনীতিতে তাই মনে হয়, আদর্শ নয়, জীবন- জীবিকাই প্রধান।পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে দলবদলের খেলা চলছে যা আগামীতে আরো হবে।
মুকল রায়, তার ছেলে শুভ্রাংশু রায়, অর্জুন সিং, তার ছেলে পবন সিং, শুভেন্দু অধিকারী, তার ভাই সৌমেন্দ্র অধিকারী, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, তার বান্ধবী বৈশাখী ব্যানার্জি, মন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জি, সল্টলেকের মেয়র সব্যসাচী দত্ত, সাংসদ সুনীল মণ্ডল, এইভাবেই দল বদল করেছেন। ভবিষ্যতে আরো বড়সড় ভাঙন তৃণমূলের জন্য অপেক্ষা করছে। হায় টাকা! হায় স্বার্থ! হায় রাজনীতি!
খুলনা গেজেট/এনএম