মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন قل ان صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين “হে নবী আপনি বলুন
নিশ্চয়ই আমার নামাজ এবং আমার কুরবানি আমার জীবন ও আমার মরন সবই বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য ” সুরা আল-আনয়াম আয়াত ১৬২
ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় কুরবানি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট পছন্দনীয় আমল। প্রত্যেক চান্দ্র বছরের শেষ মাস পবিত্র জিলহজ্জ মাসের ১০,১১ অথবা ১২ তারিখে সমগ্র মুসলিম জাতি উৎসব মুখর পরিবেশে কুরবানির এ বিধান পালন করে থাকে।
কুরবানির ইতিহাস
পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদম আ এর সময় থেকেই কুরবানির এ বিধান প্রবর্তিত। তবে কুরবানির আহকাম বা নিয়ম-কানুন পরিবর্তন হয়েছে। হযরত আদম আ এর সময় মানুষেরা কুরবানির জন্য পশু অথবা শস্য উৎসর্গ করার পরে যার কুরবানি আসমান থেকে আগুন এসে খেয়ে ফেলত সেটা কবুল হয়েছে বলে ধরা হত।পবিত্র কুরআনে আদমপুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানির ইতিহাস বর্ননা করা হয়েছে
আল্লাহ বলেন واتل عليهم نباء ابني ادم بالحق اذ قربا قربانا فتفبل من احدهما ولم بتقبل من الآخر قال لاقتلنك قال انما يتقبل الله من المتقين হে রাসুল আপনি তাদেরকে আদম আ এর দুই পুত্র (হাবিল ও কাবিলের) ইতিহাস বর্ননা করুন যখন তারা দুজন তাদের কুরবানি পেশ করল তখন একজনের কুরবানি কবুল হল অপরজনের কুরবানি কবুল হল না। সে(কাবিল) বলল আমি তোমাকে হত্যা করবো। সে (হাবিল) বলল নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। সুরা আল মায়েদাহ আয়াত ২৭
এমতাবস্থায় শুধুমাত্র হিংসার বসবতি হয়ে আদম পুত্র কাবিল তার ভাই হাবিল হত্যা করলো। আর এটাই পৃথীবির প্রথম হত্যাকাণ্ড। আল্লাহর নিকট হত্যাকাণ্ড জঘন্য অপরাধ। এ কারনে আল্লাহ বললেন
من قتل نفسا بغير نفس او فساد فكانما قتل الناس جميعا ومن أحياها فكانما احيا الناس جميعا.
যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিরপরাধ একজন মানুষ কে হত্যা করলো সে সমগ্র মানবতাকে হত্যা করলো আর একজন মানুষের প্রাণ যে রক্ষা করলো সে সমগ্র মানবতার প্রাণ রক্ষা করলো। আল মায়েদাহ আয়াত ৩২
প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রতি বছর যে কুরবানি করছি তা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ এর মাধ্যমে ইসলামি শরীয়তের অন্যতম বিধান হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম আ কে অনেক বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন আর তিনি ঈমানের এ সকল অগ্নি পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এ প্রসংগে পবিত্র কুরআনে বর্নিত হয়েছে
واذ ابتلي ابراهيم ربه بكلمات فانمهن قال اني جاعلك للناس اماما.স্মরণ কর ইব্রাহিম কে তার প্রভু এতসব পরীক্ষায় নিপতিত করলেন আর ইব্রাহিম সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হলেন তখন আল্লাহ বললেন হে ইব্রাহিম আমি
তোমাকে সমগ্র মানবজাতির ইমাম বা নেতা মনোনীত করলাম সুরা বাকারাহ আয়াত ১২৪
কাজেই মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের আত্নত্যাগ ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার ইতিহাস বাদ দিয়ে কুরবানি ও হজ্জের বিধান আলোচনা অসম্ভব। পবিত্র কুরআনের ২৫ টি সুরার ২০৪ টি আয়াতে হযরত ইব্রাহিম ও তার পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে বিষয় লিখতে গেলে বিশাল ইতিহাস গ্রন্থ হয়ে যাবে। আমরা খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঈমানী পরীক্ষা ও আত্ন ত্যাগের ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।
ইব্রাহিম আ. এর জন্ম
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা প্রাচীন মেসপটমিয় বর্তমান ইরাকের বসরা নগরীর নিকটবর্তী বাবেল শহরে মুসলিম জাতির পিতা আবুল আম্বিয়া হযরত ইব্রাহিম আ জন্মগ্রহণ করেন। তখন বিশ্বব্যাপী খোদাদ্রোহী জালিম স্বৈরশাসক নমরুদের শাসন চলছিল। ইব্রাহিম আ এর পিতা আজর ছিলেন নমরুদের রাজদরবারের প্রধান পূরহিত এবং মন্ত্রীসভার শক্তিশালী সদস্য। আল্লাহ তায়ালা তার একত্ববাদ তথা তাওহীদ প্রতিষ্টায় মানবজাতির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ইব্রাহিম আ কে এমন এক পিতার ঔরসে প্রেরণ করলেন যিনি ছিলেন মুশরিক তথা মূর্তি পূজারি দের প্রধান ঠাকুর। হযরত ইব্রাহিম আ এর জন্মকে কেন্দ্র করে নমরুদ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। রাজজ্যোতিষীরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলল অচিরেই এমন এক শিশুর জন্ম হবে যার কারণে নমরুদের বাদশাহী খতম হবে। যে কারণে নমরুদ হযরত ইব্রাহিম আ এর জন্ম ঠেকাতে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তথা স্বামী স্ত্রীর মেলামেশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো, সকল গর্ভবতী নারীদের তালিকা করে পুত্র সন্তান জন্মের সাথে সাথে হত্যার নির্দেশ প্রদান করে আইন জারি করে দিল।কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হল এবং নমরুদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত তারই প্রধান ধর্মজাজক আজরের ঘরেই তাদের দুশমন ইব্রাহিম আ কে আল্লাহ প্রেরন করলেন।
নমরুদের আগুনে ইব্রাহিম
শিশু বয়সেই ইব্রাহিম তার পিতা ও কওমের শিরকী আক্বিদা ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করলেন। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ কে বাদ দিয়ে নিজেদের তৈরি পাথরের মূর্তিকে ইলাহা বা উপাস্য বানানোর বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত প্রতিবাদ অত্যন্ত সাহসের সাথে তিনি করলেন। পবিত্র কুরআনে বর্নিত হয়েছে
واذ قال ابراهيم لابيه ازر اتتخذ اصناما االهة اني اراك وقومك في ضلال مبين.
স্মরণ কর যখন ইব্রাহিম তার পিতা আজরকে বললেন কেন তোমরা পাথরের তৈরি মুর্তিকে ইলাহা বা উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছ? আমি তোমাকে ও তোমার ক্বওমকে সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। সুরা আনয়াম আয়াত ৭৪
আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিমকে বিশ্বজগতের মহান মালিকের সীমাহীন ক্ষমতা এমন ভাবে অবগত করালেন যে তিনি গভীর অনুসন্ধানের পর দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করলেন এ আকাশ ভরা তারা, আলোকজ্জল চন্দ্র, অন্ধকার দুরকারি সূর্য কোন কিছুই আমার প্রভু হতে পারেনা।ক্বওমকে জানিয়ে দিলেন তোমাদের শিরকী কর্মকাণ্ড থেকে আমি আমাকে মুক্ত করে নিলাম। আমি ঘোষণা দিচ্ছি
اني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفا وما انا من المشركين.
আমি একনিষ্ঠ ভাবে সেই মহান স্বত্তার দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। সুরা আল আনয়াম আয়াত ৭৯
হযরত ইব্রাহিম আ এর এই সাহসী ঘোষণার সাথে সাথে তার জন্মদাতা পিতা থেকে শুরু করে গোটা সম্প্রদায় সহ বাদশাহ নমরুদ পর্যন্ত ক্ষোভে ক্রোধে ফেটে পড়লো। একপর্যায়ে খোদাদ্রোহী জালিম স্বৈরশাসক নমরুদ তাদের দেবতাদের কটুক্তি, পাথরের তৈরি মুর্তি ভাংচুর ও তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধে মুসলিম জাতির জনক,নবীগনের পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ কে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করলো। মাসব্যাপী আগুন জ্বালিয়ে বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে ইব্রাহিম কে যখন তার মধ্যে নিক্ষেপ করল এ সময় সায়্যেদুল মালায়িকা জিবরাইল আ সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন ইব্রাহিম! আপনার তো সাহায্যের প্রয়োজন, আমাকে বলুন আমি আপনার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। ইব্রাহিম বললেন حسبنا الله ونعم الوكيل
আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট তিনিই আমার সর্বোত্তম অভিভাবক।
মহান আল্লাহ তায়ালা তখন আগুনকে নির্দেশ দিলেন
يا نار كوني بردا وسلاما علي ابراهيم.
হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও।আল্লাহর নির্দেশে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড ইব্রাহিম আ এর জন্য বেহেশতের বাগানে পরিনত হয়ে গেল। আর ইব্রাহিম আ ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হলেন।
ইরাক থেকে হিজরত করে কেনয়ান( ফিলিস্তিনে) গমন
নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে বের হযরত ইব্রাহিম আ নিজ ক্বওমের নিকট আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত অত্যন্ত সাহসের সাথে পেশ করতে লাগলেন। সাধারণ মানুষের অন্তরে ভালো লাগলো কিন্তু নমরুদের অঅত্যাচারে ভয়ে তারা ইব্রাহিম আ এর দাওয়াতে সাড়া দিতে পারলনা।৭০-৮০ বছর বয়স পর্যন্ত নিজ জন্মভূমি বাবেলে স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লুত ছাড়া আত কাউকে ইব্রাহিম একত্ববাদী হিসেবে পেলেন না। এমতাবস্থায় হযরত ইব্রাহিম স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লুত কে নিয়ে ইরাক থেকে হিজরত করে কেনান তথা ফিলিস্তিনে গমন করলেন। কেনানেই তার পুত্র ইসহাক আ এবং ইসহাকের পুত্র ইয়াকুব আ এর মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
মিসরে গমন স্ত্রী সারা অপহরণের শিকারঃ দূর্বিক্ষের কারণে
কেনান থেকে হযরত ইব্রাহিম আ স্ত্রী সারাকে নিয়ে মিসর গমন করলেন। মিসরের ফেরাউন ছিল চরিত্রহীন জালিম ও মদ্যপ। কোন সুন্দরী স্ত্রী সহ কেউ সেখানে গেলে ফেরাউনের গুন্ডা বাহিনী তাকে অপহরণ করত। আর ফেরাউন তার ইজ্জত লুন্ঠন করত। ইব্রাহিম আ একই বিপদে পড়লেন স্ত্রী সারা অপহৃত হলেন ফেরাউন তার ইজ্জত লুন্ঠনের চেষ্টা করল কিন্তু নবী ইব্রাহিমের এবং পুন্যবতী সারার দোয়ায় আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের হাত-পা অবস করে দিলেন এবং ফেরাউন বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। তিন বার করে একই ঘটনা ঘটে যায়। ফেরাউন বুঝতে পারলো এরা কোন সাধারণ মানুষ নয়। তখন সে সারাকে মুক্তি দিল এবং হাজেরা নামক একজন দাষী সহ অনেক মুল্যবান উপঢৌকন প্রদান করলো। হযরত ইব্রাহিম মিসর থেকে পুনরায় হাজেরা ও সারাকে নিয়ে কেনানে প্রত্যাবর্তন করলেন। সারার অনুরোধে ইব্রাহিম হাজেরাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং এই হাজেরার গর্ভেই ইব্রাহিমের নব্বই বছরে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটির ফলে এক ধৈর্যশীল পুত্র সন্তান ইসমাঈলের জন্ম হয়। পবিত্র কুরআনে বর্নিত হয়েছে وقال اني ذاهب الى ربي سيهدين رب هبلي من الصالحين فبشرناه بعلام حليم
ইব্রাহিম বললেন আমি আমার প্রভুর নির্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। হে আমার রব আপনি আমাকে একটি নেক সন্তান দান করুন। আল্লাহ বলেন আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল সন্তানের সুসংবাদ দান করলাম।
শিশু ইসমাঈল ও মা হাজেরাকে নির্বাসন
বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর নিকট প্রার্থনার মাধ্যমে প্রাপ্ত এ পুত্র সন্তান ইব্রাহিমের কত প্রিয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় ইব্রাহিমকে এবার এক কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত করলেন আর তা হলো শিশু ইসমাঈল ও তার মা হাজেরাকে জনমানবশূন্য এক বিরান ভূমিতে নির্বাসিত করতে হবে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করে দেখেন তারা আল্লাহর জন্য কত ত্যাগ করতে পারে।
আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে নিঃসংকোচে আল্লাহর নবী ইব্রাহিম স্ত্রী হাজেরা ও কলিজার টুকরা একমাত্র পুত্র শিশু ইসমাঈলকে নিয়ে কেনান থেকে মক্কায় গমন করলেন এবং জনমানবহীন বিরান ভূমি যেখানে মানব জাতির জন্য প্রথম ঘর তথা পবিত্র কাবাঘর নির্মিত তবে সে সময় ঘরের অস্তিত্ব দৃশ্যমান ছিলনা। এই পবিত্র ঘরের সন্নিকটে রেখে ইব্রাহিম ফিরে যাচ্ছিলেন। ইব্রাহিমকে চলে যেতে দেখে হাজেরা বললেন আমাদেরকে একা ফেলে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ইব্রাহিম কোন জবাব না দিয়ে পিছনে না তাকিয়ে সামনে চলতে লাগলেন। হাজেরা কয়েক বার প্রশ্ন করার পর কোন উত্তর না পেয়ে বললেন আপনি কি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের কে এখানে ফেলে যাচ্ছেন? ইব্রাহিম হাজেরার মুখের দিকে না তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস থাকার কারণে হাজেরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ইব্রাহিম কে বললেন হে আল্লাহর নবী আপনি বিনা দ্বিধায় নিঃশ্চিন্ত্য মনে আমাদের রেখে চলে যেতে পারেন। আমি আপনাকে বাধা দিবনা। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহর নির্দেশে আপনি আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন তিনিই আমাকে ও আমার শিশু সন্তানকে হেফাজত করবেন। কয়েকদিনের মধ্যে সাথে থাকা শুকনো খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেল। খাবার ও পানির অভাবে হাজেরার বুকের দুধ শুকিয়ে গেল ফলে শিশু ইসমাঈল দুধ ও পানির জন্য ছটফট করতে লাগলেন। সন্তানের এ অবস্থা কোন মা সহ্য করতে পারেনা। পানির সন্ধানে হাজেরা বেরিয়ে পড়লেন।কাবাঘরের অদুরে সাফা পাহাড়ের উপর আরোহন করে সন্তানকে দেখে নিলেন আর পানির সন্ধান করতে লাগলেন নিকটবর্তী মারওয়া পাহাড়ে পানির মত দেখতে পেয়ে সেদিকে দৌড় দিলেন। মারওয়া পাহাড়ে উঠে সসন্তানকে দেখে নিলেন কিন্তু পানি পেলেন না।এভাবে পানির জন্য সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। আল্লাহর নিকট তার এ দৌড়াদৌড়ি কবুল হল। প্রত্যেক হজ্জ উমরাহ পালনকারির উপর সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সায়ী করা বাধ্যতামূলক করে দিলেন। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল আ এর মাধ্যমে সন্তানের পায়ের নিচে পানির ঝর্না সৃষ্টি করে দিলেন। হাজেরা সন্তানের কাছে ফিরে এসে আল্লাহর কুদরত দেখে শুকরিয়া আদায় করলেন। নিজে অঞ্জলি ভরে পানি পান করলেন সন্তানকে পান করালেন। এটাই হল ঐতিহাসিক জমজম কুপ। এ সময় অদৃশ্য এক আওয়াজ শুনতে পেলেন হাজেরা
لا تخافوا الضعية ان هذا بيت الله يبني هذا الغلام وابوه لا بضيع الله اهله.
তোমরা ভয় পেওনা। নিশ্চয়ই এখানে আল্লাহর ঘরের স্থান। এই শিশু এবং তার পিতা সেই পবিত্র ঘর নির্মাণ করবে। এই পরিবারের কোন ক্ষতি আল্লাহ করবেন না।
ইসমাঈলের কুরবানি
হযরত ইব্রাহিমকে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন একটার একটা পরীক্ষায় নিপতিত করছেন আর ইব্রাহিম সব পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছেন। এবার আল্লাহ তাকে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করলেন আর তা হলো কলিজার টুকরা একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করতে হবে। পিতা হয়ে নিজ হাতে সন্তানকে জবেহ করতে হবে। অন্যান্য পরীক্ষা আর এবারের পরীক্ষার মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট।
এ পরীক্ষায় কোন মানুষের পক্ষ থেকে ইব্রাহিম আ এর উপর কোন জুলুম বা কোন চাপ ছিলনা বরং এটা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ এবং ভালবাসার পরীক্ষা। ইব্রাহিমের অন্তরে আল্লাহর চাইতে অন্য কারোর প্রতি অধিক ভালবাসা আছে কিনা? এবারও হযরত ইব্রাহিম প্রমাণ করে দিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিনি তার সব প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন
فلما بلغ معه السعي قال يا بني اني ارا في المنام اني اذبحك فانذر ماذا ترا قال ياابت افعل ما تؤمر ستجدني ان شاء الله من الصابرين.فلما اسلما وتله للجبين وناديناه ان ايا ابراهيم قد صدقت الرؤيا انا كذالك نجزي المحسنين ان هذا لهو البليءالمبين وفديناه بذبح عظيم وتركناه في الاخرين سلام علي ابراهيم.অতঃপর পুত্র ইসমাঈল যখন পিতার সাথে কাজ করার বয়সে উপনীত হলেন পিতা ইব্রাহিম তাকে বললেন হে আমার আদরের পুত্র আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছি তোমাকে জবেহ করতে। এ ব্যাপারে তোমার অভিমত জানতে চাই।পুত্র ইসমাঈল বললেন হে আমার সম্মানিত পিতা আপনাকে যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে আপনি তা পালন করল আমাকে আ ব্যাপারে আপনি সবরকারিদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। এভাবে পিতা পুত্র উভয়ই যখন আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য আত্নসমর্পণ করলো এবং ইব্রাহিম সন্তানকে উপুড় করে শায়িতকরলেন আল্লাহ বলেন আমি তখন বললাম হে ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নাদেশ সত্যে পরিনত করেছ।এভাবেই আমি মুহসিন বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি।আর এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি বেহেশতি দুম্বা পাঠিয়ে ইসমাঈলের প্রান রক্ষা করলাম এবং পরবর্তীকালের মানুষের জন্য কুরবানির এ বিধান রেখে দিলাম। ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
আল্লাহর জন্য পুত্র কুরবানির এ নির্দেশ স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে নবী ইব্রাহিম প্রথমত একশত দুম্বা এরপর একশত উট কুরবানি দিলেন। তথাপি স্বপ্নাদেশ অব্যাহত থাকার পর তিনি একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকে জবেহ করায় জন্য মক্কার পার্শ্ববর্তী মিনায় নিয়ে গেলেন পথিমধ্যে শয়তান তিন বার ধোকা দেয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু হযরত ইব্রাহিম শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে তার আক্রমণ থেকে নিজেকে হেফাজত করেছিলেন। আজও মিনার সেই তিন স্থানে হজ্জপালনকারিদের পাথর মারতে হয়।
কুরবানির সেই ঐতিহাসিক স্থানে যাওয়ার পরে ইব্রাহিম তার পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর নির্দেশের কথা শোনালেন এবং তার মতামত জানতে চাইলেন। সন্তান ও নির্দ্বিধায় আল্লাহর আদেশ পালন করতে বললেন। এভাবে তারা দুজনই আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য প্রস্তুত।একমাত্র আল্লাহকে খুশি করতে ইব্রাহিম পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন কিন্তু ইসমাঈলের একটি পশমও কাটলনা ইব্রাহিম মনে করলেন পুত্রের প্রতি ভালবাসার কারণে হয়তো জোর হচ্ছনা। এরপর সুরির ধার পরীক্ষা করতে পাথরের উপর আঘাত করতে পাথর দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। পরিশেষে চক্ষু বন্ধ করে ছুরি চালাতেই কুরবানি হয়ে গেল তবে ইসমাঈল নয় একটি জান্নাতি দুম্বা। হযরত ইসমাঈলের প্রান রক্ষার্থে আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে দুম্বা নিয়ে হাজির। দুম্বা কোরবানি হওয়ার সাথে সাথে জিবরাইল আ পড়লেন আল্লাহু আকবর, ইসমাঈল পড়লেন আল্লাহু আকবর, এরপর ইব্রাহিম ও পড়লেন আল্লাহু আকবর। চতুর্দিক থেকে আওয়াজ উচ্চারিত হল আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ। এই তাকবিরে তাশরিক জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফরজ থেকে ১৩ তারিখ আসর নামাজ পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পাঠ করা ওয়াজিব।
কুরবানির হুকুম
হযরত ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত কুরবানির এ বিধান মুসলিম জাতির উপর ওয়াজিব। প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম বালেগ এবং স্বাধীন নর নারীর উপর যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক জিলহজ্জ মাসের ১০,১১অথবা ১২ তারিখ এই কুরবানি ওয়াজিব।
কুরবানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
শুধুমাত্র মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কুরবানী করতে হবে। লৌকিকতা,প্রদর্শনিচ্ছা বা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য কুরবানি করলে সে কুরবানি কবুল হবেনা। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন
لن ينال الله لحومها ولا دماءها ولكن يناله التقوي منكم
আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানির পশুর গোশত এবং রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবেনা বরং তোমাদের তাক্বওয়া বা অন্তরের আল্লাহভিতি তথা সহীহ নিয়তই তার কাছে পৌঁছিবে।
এছাড়া পশু কুরবানির সাথে সাথে নিজের ভিতরের পশুত্ব বা পাশবিকতাকেও কুরবানি দিতে হবে। অর্থাৎ কুরবানির মাধ্যমে অন্তরের লোভ লালসা, হিংসা বিদ্যেশ,অহংকার, আত্ন অহমিকা, ঘৃনা জিঘৎসা সব খারাপ স্বভাব দুর করতে হবে।
হযরত ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত কুরবানির বিধান পালন করতে আমাদেরকে এই পরিবারের আত্নত্যাগ ও ঈমানী পরীক্ষার ইতিহাস অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে। এ জন্যই মহানবী সা আমাদের সকল নামাজের শেষ রাকাতে তাশাহহুদের পরে দরুদ শরীফের বিধান রেখে ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের স্মৃতি চারনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
اللهم صل على محمد وعلي ال محمد كما صليت علي ابراهيم وعلي ال ابراهيم انك حميد مجيد اللهم بارك علي محمد كما باركت على ابراهيم وعلي ال ابراهيم انك حميد مجيد.
হে আল্লাহ তুমি হযরত মুহাম্মাদ স ও তার পরিবারের উপর রহমাত নাজিল কর যেমন রহমাত নাজিল করেছ ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের উপর।নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ও মার্যাদার অধিকারী। হে আল্লাহ তুমি বরকত নাজিল কর হযরত মুহাম্মাদ স ও তার পরিবারের উপর যেমন বরকত নাজিল করেছ ইব্রাহিম আ ও তার পরিবারের উপর।নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ও মার্যাদার অধিকারী।
কুরবানি করার পর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে
اللهم تقبل منا كما تقبلت من حبيبك محمد صلى الله عليه وسلم وخليلك ابراهيم عليه الصلاة والسلام.
হে আল্লাহ তুমি আমাদের কুরবানি কবুল কর যেমন তুমি তোমার হাবিব মুহাম্মাদ স ও তোমার খলিল ইব্রাহিম আ এর কুরবানি কবুল করেছ। আমীন।
(লেখক : অধ্যক্ষ তালীমুল মিল্লাত রহমাতিয়া ফাযিল মাদরাসা,খুলনা)
খুলনা গেজেট / এমএম