বিশ সালের ৩৬৫ দিনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতে বসলে অধিকাংশের না পাওয়ার পাল্লাটাই ভারী হবে। এজন্যই বোধ হয় অনেকে ২০২০ সালকে ‘বিষময়’ আখ্যা দিয়েছেন। বিগত সময়ের ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে নতুনের কেতন ওড়ানোর আনন্দ উপভোগ করতে চাই সবাই। অকল্যাণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে অবারিত কল্যাণের দিকে এগিয়ে যাবে সোনার বাংলাদেশ, এমন প্রত্যাশাই সবার। নতুন এবছর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
একটা স্বাভাবিক জীবন চাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিন আশা বলেন, “নতুন বছর আসে নতুন আশা, স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে। করোনা মহামারীর জন্য গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব বন্ধ রয়েছে। অনেক বড় একটা সময় আমরা বাসায় বসে আছি। যদিও অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চলছে, তবুও আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। করোনায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সেশনজট সৃষ্টি হয়েছে।”
নতুন বছরের তাসনিন আশার প্রত্যাশা, “দ্রুতই হল খুলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে আমাদের পরীক্ষা এবং ক্লাসগুলো সম্পন্ন হোক। আমরা যাতে পিছিয়ে না পড়ি এ ব্যাপারে আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নজর দিবে। করোনা ভাইরাস সবার জীবনে একটা প্রভাব ফেলেছে। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সবাই পার করেছে গত বছরটা। অনেকেই দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছেন। ইতিমধ্যে আমাদের ক্যাম্পাসে ১০ এর বেশি আত্নহত্যার খবর পেয়েছি। এমন নেতিবাচক ঘটনা আমাদের কাম্য নয়। আমরা দ্রুতই যেনো আগের মতো সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরতে পারি। নতুন এ বছরে একটা স্বাভাবিক জীবন চাই।”
শিক্ষর্থীদের জন্য গবেষণা খাত হোক সহজলভ্য
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালমান হাফিজ বলেন, “একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমার ভাবনা নতুন বছরে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ পাবে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। সীমাবদ্ধতার সুযোগ না নিয়ে বরং সীমাবদ্ধতা কিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় সে ব্যাপারে যৌথভাবে কাজ করবে।”
নতুন বছরে উচ্চশিক্ষার একটি জায়গা নিয়ে সালমান হাফিজের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেটি হলো, “শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা খাতকে আরো সহজলভ্য করা। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখতে পাই নির্দিষ্ট একটি সিজিপিএধারী না হলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা গবেষণার কাজ করতে পারেন না। গবেষণা যার পছন্দ সেই শিক্ষার্থী যেন গবেষণার কাজ করতে পারে, হোক সেটা অনার্স কিংবা মাস্টার্স পর্যায়ে। গবেষণা খাতকে সহজলভ্য করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো যথাযথ অর্থ সরবরাহ। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, যদি একটি সেশনের ১০ জন শিক্ষার্থী গবেষণার কাজে আগ্রহী হয় তবে বিভাগ থেকে ৩-৪ জনকে যৎসামান্যই আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর্থিক সংকটের কারণে গবেষণা করা হয়ে ওঠে না। এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যাশা থাকবে, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশেও শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা খাত সহজলভ্য হবে। গবেষণার ফল ছড়িয়ে যাবে সারা বিশ্বে।”
বন্ধ হবে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিম্মা রহমান রীতি বলেন, “বিদায়ী বছরটি ছিলো দু:স্বপ্নের মতো। করোনা ভাইরাস আমাদের অনেকের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের একটি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তার আগমন। লকডাউনে ঘরে হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে নতুন কিছু করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে তরুণ উদ্যোক্তাদের ভিতর। আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিলেও করোনা অনেক মানুষকে দেখিয়েছে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উপায়।”
মিম্মা রহমান রীতি আরও বলেন, “দু:খজনক হলেও সত্য করোনার ভেতরেও ঘটেছে ধর্ষণ, নারী র্নির্যাতন আর যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। এখনো রাস্তায় ঘাটে, গণপরিবহণে নারীরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। স্বাচ্ছন্দে চলাফেরার অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে কুরুচিপূর্ণ কিছু মানুষের লোলুপদৃষ্টি। নতুন বছরের প্রত্যাশা নারীর জন্য সমাজ হবে নিরাপদ। আমার আপনার ঘর থেকেই শুরু হোক নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পাশাপাশি বন্ধ হোক নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো।”
শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় গতি ফিরে আসুক
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ বলেন, “২০২০ সাল আমাদের অনেকের কাছেই সুখকর ছিলোনা। অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। গতি হ্রাস করেছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, শিক্ষাব্যবস্থা সহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরের। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও হয়েছে অনেক শোরগোল। একের পর এক হারিয়েছি আপনজন আর সংস্কৃতি অঙ্গনের গুনীজন।”
সাব্বির আহমেদের প্রত্যাশা, “মহাবিপর্যয়ের ভিতরেও পৃথিবী ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ধীর পায়ে। ভ্যাকসিনও প্রয়োগ হচ্ছে অনেকগুলো দেশে। ধীরে হলেও চলতে শুরু করেছে থেমে থাকা মিল, ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকা। উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো ইতোমধ্যেই আমাদের থেকে এগিয়ে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের এগোতে হবে নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি গতি ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষা, অর্থনীতি, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ সকল অঙ্গনে।”
স্বপ্নের জাল বোনা, নতুন বছর হোক পরিপূর্ণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ, “ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দে কেটে গেলো একটি বছর। দেখতে দেখতে চলে এল নতুন বছর! আর এমনই একটা বছর ফেলে এলাম, যা আমাদের ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। কিন্তুু বিগত বছরটা আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেছে তা কখনো ভুলার নয়। এখনো মানুষ অপেক্ষায় আছে, অসুস্থ পৃথিবী কবে সুস্থ হবে, কবে আগের মতো মানুষ তার জীবনকে সহজভাবে ভাবতে পারবে।”
রাজু আহমেদের ভাবনা, “বিষের বছর পেরিয়ে নতুন বছর এসেছে চলে। নতুন বছর মানে আমাদের বিগত দিনের গ্লানি মুছে দেশ ও জাতির নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন পুরণের বছর। বিগত বছরের ভুলগুলো আলোতে রূপান্তরিত করে, নানান প্রতিক‚লতার মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে বিশ্বের বুকে। আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে। কাজ করতে হবে বেকারত্ব ঘোচাতে। টেকনোলজিকে কেন্দ্র করে গেøাবাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে। সব বাঁধা ভেদাভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। গড়তে হবে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। নতুন বছর হোক স্বপ্নের জাল বোনা পরিপূর্ণের বছর।”
মাদকমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের প্রত্যাশা
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিফাত আলম সান বলেন, “নতুন বছরে সবকিছু নতুন করে শুরু হোক আবারও। করোনার থাবায় আমরা যতটুকু পিছিয়ে গেছি নতুন বছরে যেনো দ্বিগুন গতিতে এগিয়ে যেতে পারি। দু:স্বপ্নের স্মৃতি ভুলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন সূর্যকে অভিবাদন।”
নতুন বছরে সিফাত আলম সানের প্রত্যাশা, “মাদকের ছোবলে যেনো হারিয়ে না যায় সহপাঠী, বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী কিংবা আমার আপনার পরিচিতজন। বিশেষ করে, শিক্ষার্থী যারা আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যত তারা যদি মাদকের কালো স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, জাতিকে পথ দেখানোর পরিবর্তে তারা নিজেরাই পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রথম বর্ষের অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায় কৌতুহলবশত কিংবা কারো প্ররোচনায় মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকবে আমরা মাদকমুক্ত সমাজ এবং শিক্ষাঙ্গন পাবো। পাশাপাশি সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেকে এবং পরিবারকে সমর্থন যোগানোর যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি করোনা থেকে তা যেনো সবসময় অব্যাহত থাকে।”
খুলনা গেজেট/ টি আই