বাংলাদেশের স্হপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কলকাতা মহানগরীর স্মৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাবেক ইসলামিয়া কলেজ যার বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ (তার আগে এর নাম ছিল সেন্ট্রাল ক্যালকাটা করেসপন্ডেন্স কলেজ) এর ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাই নয়, ১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় তাঁর ছাত্রজীবন কাটে । মৌলানা আজাদ কলেজ অবস্থিত মধ্য কলকাতার নিউমার্কেট সংলগ্ন রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে (সাবেক ওয়েলেসলি স্ট্রিট)। এটি কলকাতার অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র তালতলা সংলগ্ন।
নানান কারণে এই তালতলা এলাকা স্মরণীয়। এই তালতলা এলাকার ৩/৪সি তালতলা লেনে কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ লেখেন। এখানেই মনীষী সৈয়দ আমির আলি প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। এখানেই থাকতেন ফরিদপুরের ভূমিপুত্র বাংলার আরেক নবজাগরণের অগ্রপথিক নবাব আব্দুল লতিফ। এই এলাকার ওয়েলেসলি লেনে ছিল অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অফিস। এই এলাকার নিউমার্কেট লাগোয়া সদর স্ট্রিটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ কবিতাটি। এই এলাকার একটি বিখ্যাত রাস্তার নাম মির্জা গালিব স্ট্রিট, যার সাবেক নাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিট । স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ মিত্র বা সুরেন্দ্রনাথ সহ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের স্মৃতি বিজড়িত ও স্মৃতি ধন্য এলাকা তালতলা।
১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত তখনকার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। আবার ইসলামিয়া কলেজের দেশ বিভাগ সময় পর্যন্ত ছাত্র সংসদের জি এস। মৌলানা আজাদ কলেজের ভিতরে এই তালিকায় তার নামটি লেখা রয়েছে এম রহমান। এটা আমাদের কাছে যথেষ্ট বিস্ময়কর । তিনি একটা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের জনক। যাকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তার নাম শুধু এম রহমান রেখে মানে এক ধরনের দায়সারা গোছের এবং অবশ্যই বেমানান।
১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের নেতা। আবার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় কলকাতার মনুমেন্টের পাশে (এখন শহীদ মিনার ময়দান) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ডাকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দেওয়া হয় তাকে সফল করতে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন গভীর স্নেহভাজন ছিলেন। বলা যেতে পারে শহীদ সাহেব ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু। কিন্তু নানান কারণে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল। তাই নেতাজীর নেতৃত্বে যখন কলকাতার ডালহৌসি এলাকা থেকে হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর আন্দোলন শুরু হয় তখন সেই আন্দোলনেরর সঙ্গেও তিনি যুক্ত হন।
১৯৪৩ সালে বাংলায় বড়সড় দুর্ভিক্ষ। তখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন কৃষক প্রজাপাটির তরুণ তুর্কী সৈয়দ বদরুদ্দোজা। আবার বাংলায় তখন খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলীম লীগের সরকার । সে সময় তরুণ মুজিবুর রহমান দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন ১৯৪২-৪৭ পর্যন্ত কাটলেও ১৯৩৪-৩৬ এবং ১৯৩৯ সালে চোখের চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতা আসতে হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপুরুষ শেখ আব্দুল আওয়াল আসেন ইরাকের বাগদাদের হাসনাবাদ শহর থেকে। বাংলার মাটিতে ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে তাদের বংশের অনেকেই কলকাতা আসতেন। রানীরাসমণির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বংশের অনেকেরই জমি- জায়গা নিয়ে মামলাও চলেছে। আবার বঙ্গবন্ধুর এক মামার কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় একটি বিশাল রেস্টুরেন্টও ছিল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। বর্তমানে ঐ রাস্তার একাংশের নাম সৈয়দ আমির আলি এভিনিউ।
আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক স্ফুরণটা ঘটেছে কলকাতায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে । তাই কলকাতায় তিনি দেখেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের যন্ত্রণা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় অতিথি করে নিয়ে যান।
আবার ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী বেকার হস্টেলে যে ঘরে বঙ্গবন্ধু থাকতেন সেটিকে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে পরিণত করেন। সেটিকে আরো পূর্ণ রূপ দেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক সংখ্যালঘু মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর জন্য ব্রিগেড সমাবেশে যে লোকসমাগম হয় তা এ যাবত পর্যন্ত সর্ববৃহত্তম সমাবেশ। তাই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্মৃতিময় কলকাতা আজো মানুষের মনে সদাজাগ্রত। বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে কলকাতা বঙ্গবন্ধুকে ভুলেনি।
খুলনা গেজেট / এমএম